Same old story of our national heroes !
শেষযাত্রায়ও অবহেলিত মাহবুব
জীবিত থাকতে অবহেলা আর অসম্মানই বেশি জুটেছে। মৃত্যুর পরও মাহবুব আলমের ভাগ্য বদলাল না। অযত্ন আর অবহেলাই সঙ্গী হলো অন্তিমযাত্রায়। তা দেখে চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলেটের অসাড় দেহ যেন বিদ্রূপই করছিল এ দেশের ঘুণে ধরা ক্রীড়াঙ্গনকে।
২১ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন সাফ গেমসে টানা দুবারের দ্রুততম মানব শাহ আলম। আরেক চ্যাম্পিয়ন মাহবুব আলমের জীবনেও ফাঁদ পাতল অনিরাপদ সড়ক। মাত্র ৪০ বছর বয়সে কাল পৃথিবীকে বিদায় জানালেন ১৯৯৫ মাদ্রাজ সাফে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনাজয়ী অ্যাথলেট। ১৯৯৯ কাঠমান্ডু সাফে ফটো ফিনিশিংয়ে ২০০ মিটারেই রুপাজয়ী এবং দেশে ১০০ ও ২০০ মিটারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাথলেটের জীবনে আরেকটি ভোরের আলো ফুটল না।
কাল বিকেলে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অ্যাথলেটের মরদেহ গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে যাত্রা করার সময় ক্রীড়া পরিষদের সচিব ছাড়া ক্রীড়া প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন আর কেউ নেই! ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী-বিওএর সভাপতি-মহাসচিবসহ ক্রীড়াঙ্গনের বিশিষ্টজনের শেষ শ্রদ্ধা পাওয়ার দাবি রাখেন মাহবুব আলম। যেকোনো কারণেই হোক, তাঁরা ছিলেন না।
বিদেশ যাওয়ার জন্য লোকের অভাব হয় না, সরকারি টাকায় দেদার ঘুরে বেড়ানোর সংস্কৃতি জাঁকিয়ে বসেছে এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে। কিন্তু সোনাজয়ীর কফিনে ফুল দেওয়া নিয়ে কে অত ভাবে! জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কি একটা ফুল বরাদ্দ করতে পারত না মাহবুব আলমের জন্য? বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের পক্ষ থেকেই শুধু ফুল দেওয়া হয়েছে কফিনে।
আহাজারি করে গেলেন তাঁর স্বজন আর অ্যাথলেটিকস অঙ্গনের অনেকেই। মাহবুব আলমের বৃদ্ধ মা হালিমা খাতুনের বিলাপের ভাষাটা বুঝিয়ে দিলেন, কী এক অনটন আর কষ্টের জীবন ছিল এই চ্যাম্পিয়নের! ‘আমার পুলারে আই না দে...। বাবা তোরে জমি-জমা সব বেইচ্চা বিদেশ পাডামু, তুই ফিইরা আয়’—হালিমা খাতুন কী বোঝোলেন? ছেলেকে শ্রমিক বানিয়ে বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিলেন।
একমাত্র ভাইকে হারিয়ে ছোট দুই বোনের একজন মাহমুদার অবস্থা ছিল পাগলপ্রায়। বাবা নেই, এই ভাই-ই ছিলেন অভিভাবকের মতো। তাঁকে হারিয়ে বোনের মনে নানা প্রশ্ন, ‘মাইক্রোবাসে আরও লোক ছিল। কারও কিছু হলো না। শুধু আমার ভাই মইরা গেল! ইয়াহিয়া আমার ভাইরে মাইরা ফালাইছে!’ মাহবুব আলমের শ্যালক জানাজার ঠিক আগে উগরে দিলেন ক্ষোভ, ‘এই কফিন জাতীয় পাতাকায় আচ্ছাদিত নয় কেন? কেন ময়নাতদন্ত করা হলো না?’
নিয়ম না থাকায় পতাকা দেওয়া যায়নি—ব্যাখ্যা দিলেন অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটারই গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই তাঁর মুখে। সাফে সোনা জেতার পর তখনকার ফেডারেশনের দেওয়া প্রতিশ্রুত এক লাখ টাকা পুরস্কার কেন এত দিনেও পেলেন না মাহবুব আলম? নিজে কর্মকর্তা হিসেবে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন, সেই কথা উল্লেখ করে শাহ আলম বললেন, ‘এ রকম লিখিত কিছু ছিল না। তবে আমরা এখন ওই টাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করব!’
হায়, ১৫ বছর পর মাহবুব আলম এখন পুরস্কারের টাকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পান! পরকালে গিয়ে এই ক্রীড়াঙ্গনকে যাঁর বলা উচিত, ‘তোমাদের টাকা আর আমার দরকার নেই। ওই টাকা দিয়ে কারও বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করো!’
তবে সতীর্থ খেলোয়াড়, কোচ, জুনিয়র খেলোয়াড়দের কাছ থেকে যোগ্য স্বীকৃতি এবং সম্মান—দুটোই পেয়েছেন মাহবুব আলম। মরদেহ স্টেডিয়ামের ভেতরে আনার পর কাফনের কাপড় সরিয়ে মুখটা খুলতেই সাবেক দ্রুততম মানব মাসুদুল করিম, আল আমিন, ফৌজিয়া হুদা, ইভারা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। নীরবে চোখ মুছলেন উপস্থিত সবাই। ভাঙা পা নিয়ে স্টেডিয়ামে আসতে পারেননি, ঘরে বসেই ফোনে হাউমাউ করে কাঁদলেন শামীমা সাত্তার (মিমু), ‘অ্যাথলেট এবং মানুষ হিসেবে ও ছিল ব্যতিক্রম।’
কেমন অ্যাথলেট ছিলেন মাহবুব? সাফ গেমসের দুবারের দ্রুততম মানব প্রয়াত শাহ আলমের চেয়েও মাহবুবকে এগিয়ে রাখলেন কোচ আবদুল খালেক, ‘আমার চোখে মাহবুবই আমাদের ইতিহাসের সেরা অ্যাথলেট।’ নজরুল ইসলামের (রুমি) কথা, ‘ওর ফিগারটাই ছিল পরিপূর্ণ একজন অ্যাথলেটের। পরিচর্যাকরা গেলে এশিয়ার সর্বোচ্চ স্তরেও পদক আনার সামর্থ্য রাখত।’
কিতাব আলীর চোখে, ‘ওর মতো অ্যাথলেট আসেনি, আসবে কি না সন্দেহ।’ সুফিয়া খাতুনের বিশেষণটাও একই রকম, ‘ও ছিল সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলেট।’