ক্রিকেট-সংস্কৃতির বিকাশ চাই
আবুল মোমেন | তারিখ: ২১-০৮-২০১১
আমি একটু বেশি সংস্কৃতি-সংস্কৃতি করে থাকি। আমি মনে করি, রাজনীতি, শিক্ষা, ক্রীড়া, স্বাস্থ্য এসবই ধারণ ও লালন করে থাকে সেই বিষয়ের সংস্কৃতি। শিক্ষার প্রসঙ্গে এ কথাটা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন।
ওপরের সব ক্ষেত্রেই আমাদের যেসব সাফল্য আছে—মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসহ—সবই আমাদের ভূমিকায় আজ বিচ্ছিন্ন ঘটনা যেন। কারণ, অর্জনগুলোকে ধারাবাহিকতার মাধ্যমে স্থায়িত্ব দিতে ও বিকশিত করতে পারিনি। এর কারণ আমি বলব, সাংস্কৃতিক দৈন্য ও অসচেতনতা।
যেকোনো বিষয়ই নিয়মিত চর্চা ও ভালোবাসার বন্ধনেই ক্রমে জীবন যাপনের অংশ হয়ে ওঠে। আর এটাই হলো সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক বন্ধন ও বাতাবরণ তৈরি না হলে সবকিছুই ব্যক্তিগত এবং বস্তুগত লাভালাভের মানদণ্ডে ভোগেই শেষ হয়।
অসুস্থ প্রতিযোগিতা কেবল রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, স্বাচিপ-ড্যাবের মৌরসিপাট্টা কায়েমের কাণ্ড দেখুন, শিক্ষকদের হলুদ-নীলের তামাশা দেখুন। এভাবে চললে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এক-দুজন তারকা বেরিয়ে আসতে পারে; কিন্তু বেশি ঘটবে কায়েমি স্বার্থবাদী ক্ষমতাধর ব্যক্তির উত্থান।
অন্যান্য ক্ষেত্রের দুর্বলতার মতো আমাদের ক্রিকেটও এই দুর্বলতা নিয়েই চলছে। জিম্বাবুয়ে ছয় বছরে তার ক্রিকেট-সংস্কৃতির ভিত শক্ত করেছে—সেখানে সাদা-কালোরা একসঙ্গে কাজ করছে।
বলতে কি, সদ্য সমাপ্ত লজ্জার টেস্টটিতে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে তরুণ ভিটরির বল দেখেই বুঝেছি বাংলাদেশের জন্য খেলাটা সহজ হবে না। পেশাদারি মনোভাব ও তারকা মনোভাবের মধ্যে যোজন যোজন পার্থক্য। তারকা তো তোয়াজে অভ্যস্ত, আত্মমুগ্ধ মানুষ, তাই খেয়ালি, অন্যদের ব্যাপার, এমনকি সহখেলোয়াড়, দল, দেশ তাদের মাথায় একযোগে কাজ করে না। বিচ্ছিন্নভাবে নিজের খেলা নিয়ে আত্মমগ্ন মানুষ পূর্বাপর অবস্থা বুঝে নিজের ভূমিকা নির্ধারণ করতে পারে না। গত টেস্টে আমাদের প্রধান ব্যাটসম্যান আশরাফুল, সাকিব, তামিমদের আউটগুলো দেখুন।
ক্রিকেট ঠিক ফুটবলের মতো গতি, শক্তি, দক্ষতা অর্থাৎ প্রধানত শরীরী-কুশলতানির্ভর খেলা নয়। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে সেটা কিছুটা চলতে পারে; কিন্তু টেস্ট ম্যাচে মাথা খাটিয়ে দলের কৌশল ঠিক করতে হয় আর প্রতিটি পর্যায়ে প্রত্যেক খেলোয়াড়দের করণীয় ঠিক করতে হয়। কোনো কোনো পর্যায়ে ব্যাটিংয়ে প্রায় বলে বলে কৌশল-করণীয় ঠিক করতে হয়।
সে জন্য ক্রিকেটে দলপতি এক বিশেষ ব্যক্তি, সত্যিকারের নেতা, অভিভাবক এবং তাঁকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়, প্রয়োজনে প্রচণ্ড চাপ নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হয় তাঁর। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফ্রাঙ্ক ওরেল, অস্ট্রেলিয়ার রিচি বেনো, শ্রীলঙ্কার অর্জুনা রানাতুঙ্গা, ইংল্যান্ডের পিটার মে এ রকম কয়েকজন অধিনায়ক।
যতদূর বুঝতে পারছি, হয়তো অকুস্থলে থেকে উৎপল শুভ্র আরও ভালো বুঝতে পারবেন, জিম্বাবুয়ে দলের এই পুনর্গঠন ও পুনরুজ্জীবনের পেছনে সাবেক ক্রিকেটারত্রয়ী আলিস্টার ক্যাম্পবেল, হিথ্ স্ট্রিক এবং গ্রান্ট ফ্লাওয়ারের দারুণ ভূমিকা ছিল। তাঁরা নিশ্চয় ঘরোয়া ক্রিকেটকে ফলপ্রসূভাবে সাজিয়েছেন। সেটা আমাদের জানা দরকার।
যদি ক্রিকেট-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ পেশাদারি মনোবৃত্তির মানুষেরা ক্রিকেট প্রশাসনে যুক্ত না হন, সরকার যদি তাঁদের যথাযথ সমর্থন না জোগান, তাহলে যে দু-চারজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় উঠে আসছেন জেলাশহর থেকে, তাঁরা হয় হাউই বাজির মতো অকালে ফুরিয়ে যাবে, নয়তো ‘কি হনুরে’ ভাব নিয়ে বখে যাবে। আর বাংলাদেশের ক্রিকেট মার্কটাইম করে যাবে, সামনে এগোবার জন্য মার্চ পাস্ট করা হবে না। গত ৪ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সোয়া চার দিন স্থায়ী টেস্টে জিম্বাবুয়ে দলের মার্চ পাস্ট দেখতে দেখতে হতাশা ও লজ্জায় ডুবে যাচ্ছিলাম।
পেছন থেকে এসে আমাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার কাহিনি অবশ্য নতুন নয়। প্রায়ই আফসোস শুনি, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম তো এই ষাট-সত্তরের দশকেও আমাদের পেছনে ছিল। আজ আমাদের ছাপিয়ে কোথায় গেছে!
ঝগড়া-ঝাঁটি, খেয়োখেয়ি আর দখলবাজিতে ব্যস্ত থাকলে এ রকমই হওয়ার কথা। অর্থাৎ যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
বাঙালির মনে সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব আছে, জানি আমাদের রবীন্দ্র, নজরুল, লালন আছেন। সবই ঠিক। আসলে তাঁদের আজীবনের সাধনার যে ফসলগুলো আমাদের কাছে পৌঁছায় সেগুলো হলো শিল্পকলা, যা আবার ব্যক্তিকে শিল্পী ও তারকা বানায়। আমরা কি স্কুল-কলেজে, পাড়ায়-এলাকায়, পরিবার-সমাজে, জীবনে-চিন্তনে তাঁদের চিন্তা-চেতনা-দর্শনকে ধারণ-লালন করি? করি না। ফলে আমরা কেউ বা হয়ে পড়ছি ভূঁইফোড় আর কেউ সাংস্কৃতিক উদ্বাস্তু। একদল প্রদর্শন করছে ক্ষমতার রোয়াব আরেক দল মূর্খতার জ্যাঠামি।
অন্য খেলার চেয়ে ক্রিকেট একটু বেশি সংস্কৃতি-মনস্ক। এর ইতিহাস ও অর্জনগুলো, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্বদের জানা না থাকলে, সে নিয়ে আবেগ ও গর্ব তৈরি না হলে ক্রিকেটের সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগটা ঘটবে না। আর সে যোগটা ঘটলে নিজের সামর্থ্য, দলের প্রয়োজন, খেলার সেই সময়ে নিজের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, তা ভাবার মন তৈরি হবে। নয়তো সবাই সব সময় ভিভ্ রিচার্ডস-মার্কা রংদার ব্যাটিং করে গ্যালারি মাতানোর ফাঁদে পা দেবে। বুঝবেই না যে ক্রিকেটের ইতিহাসে ভিভ্ রিচার্ডস গন্ডায় গন্ডায় আসেনি, একদলে একসঙ্গে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
অল্পতেই আমাদের খেলোয়াড়দের মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে, পথ হারাচ্ছে, খেই হারাচ্ছে তারা। কী রকম নীরবে অলক্ষ্যে আলিস্টার কুক করেছে ১৯টি টেস্ট সেঞ্চুরি! আমাদের নিত্য খবর হওয়া, প্রচার পাওয়া তামিম-আশরাফুলরা কবে ১০টি টেস্ট সেঞ্চুরি করবেন?
সত্যি কি একটি মানসম্পন্ন টেস্ট দল তৈরি করতে পারছি আমরা? জুনায়েদ-রিয়াদ-নাঈমরা কি টেস্ট মানের ব্যাটসম্যান?
ইংল্যান্ডের নয় নম্বর ব্রডেরও বিশাল সেঞ্চুরি আছে টেস্টে। বোলারদের থাকে ঘরোয়া ক্রিকেটে ডবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর রেকর্ড। নিজের খেলা তো নিজেকেই খেলতে হবে। ১০ বছরে তো নজরে পড়ার মতো অগ্রগতি হওয়া উচিত ছিল। কই, তার কোনো লক্ষণ আছে!এ অবস্থায় আবারও বলব—সংস্কৃতি সংস্কৃতি সংস্কৃতি। ক্রিকেট-সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসার ব্যতীত উন্নতির কোনো কারণ নেই, ধারাবাহিকতা অর্জনের সুযোগ নেই।
http://www.prothom-alo.com/detail/da...26/news/179839
__________________
সবাই সুখে সুখী হলে বলো তবে হবে কে ভবঘুরে
|