March 15, 2008, 04:28 PM
|
|
Test Cricketer
|
|
Join Date: February 11, 2006
Location: http://twitter.com/irteja
Favorite Player: Sakib, Tamim, Tendulkar
Posts: 1,869
|
|
মানজারুল ইসলাম রানা এখন কেবল দেয়ালে ঝোলানো ছবি। অকাল প্রয়াত এই ক্রিকেটারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মাস চারেক আগে রানার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু মাশরাফির সঙ্গে রানাদের বাড়ি ঘুরে এসে এই লেখাটি লিখেছিলেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
‘এই যে। এই ঘরটাতে আমরা থাকতাম, এই ঘরে সবাই বসে আড্ডা দিতাম। এদিকে দেখ, এই আলনাটা তখন ছিল না। ওই কোণে থাকত ক্রিকেটের কফিন...’
চকচকে চোখে ঘরটার এ কোনা থেকে ও কোনায় ছুটে চলেছে ছেলেটা। দুই চোখে অসীম আগ্রহ নিয়ে নীরবে ছেলেটার বর্ণনা শুনছেন তাঁর স্ত্রী। এর মধ্যে মা এলেন। চেয়ে দেখলেন ছেলেকে, ছেলের বউকে। ডাক দিলেন, ‘বাবা, খেতে আসবি না? বউমাকে নিয়ে খেতে আয়।’ রানার মায়ের পেছন পেছন এগোতে থাকেন তাঁর ছেলে আর বউ। একটু দুরে ওদের নীরবে অনুসরণ করেন রানার বাবা।
গুমোট বাড়িটাতে অনেক দিন পর আবার যেন একটু খোলা হাওয়া ফিরে এসেছে। টিউবলাইটের মরা আলো কালকের চেয়ে একটু উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। ভেজা চোখ মুছতে মুছতে তিনি চেয়ে দেখেন, রানার মায়ের দুই হাত ধরে খাবারের ঘরের দিকে হেঁটে চলেছেন তাঁর ছেলে আর বউ। মায়ের কাঁধের ওপর মাথাটা এলিয়ে দিয়ে হাঁটছে অত বড় ছেলেটা।
"܃܃"
সাহিত্যে, কল্পনায় জাদুবাস্তবতা বলে একটা ব্যাপার আছে। সেখানে হয়তো একদিন চুপিসারে মায়ের কোলে ফিরিয়ে আনা যেত মানজারুল ইসলাম রানাকে। কিন্তু এই দুনিয়াটা সত্যিই বড় নির্দয়। জাদুগুলো এখানে আর বাস্তব হয়ে ফিরে আসে না। তাই নিজেদের বাড়িতে আর ফিরে আসেন না মানজারুল ইসলাম রানা। নিকষ অন্ধকার আর শুন্যতায় ভরে থাকে তাঁর ঘরটা। এর মাঝে একটু আলো নিয়ে মাঝেমধ্যে ফিরে আসেন রানার বাবা-মায়ের কাছে নিজেকে ছেলে হিসেবেই দাঁড় করানো মাশরাফি। আবদারে, আহ্লাদে, মা-বাবার প্রতি কর্তব্যে ভুলিয়ে দিতে চান বাল্যবন্ধু রানার শুন্যতাকে। তাই কি হয়! তার পরও একটু চেষ্টা করে যাওয়া।
"܃܃"
মাশরাফি বিন মুর্তজা আর তাঁর স্ত্রী সুমি খুলনায় এলে রানার বাড়িতে বেড়াতে যাবেন, এটা তাঁদের পরিচিত জগতে নতুন কোনো খবর নয়। খুলনায় এলে তারপর যেতে হবে, মাশরাফির বেলায় এ কথা সাজে না। রানার বাসায় আসেন নিজের বাড়িতে আসার আগ্রহ নিয়ে। যে আগ্রহে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে ফিরেই বলেছিলেন, ‘আগে রানার বাড়ি যাব।’ সেই ছোটবেলায় তৈরি হওয়া অভ্যেস।
প্রস্তাবটা দিতেই তাই রাজি হয়ে গেলেন, ‘আমি তো প্রায়ই যাই। এই তো কালও গেলাম, আজও যাব। চলুন না হয় সঙ্গে।’ খেলা শেষ করে হোটেলে গিয়ে স্ত্রীকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে মাশরাফি হাজির মুজগুন্নিপাড়ায়। এলাকার লোকজন অবশ্য বলে, কাজীপাড়া।
কাজীপাড়ার কাজী মানজারুলদের বাড়িতে মাশরাফি কতটা নিয়মিত মুখ, তা ঢুকতেই টের পাওয়া গেল। ছোট্ট একটা গলিপথ ধরে এগোতে হচ্ছে। দুই পাশে আরও কতগুলো বাড়ি। মোটরসাইকেলের শব্দ পেয়ে ছুটে এল দুই শিশু, ‘কে? মাশরাফি ভাই?’ মাশরাফি একটু পেছনে আসছে বলতেই দুই জনের মধ্যে ছোট ছেলেটি বলল, ‘আমরা জানি মাশরাফি ভাই আসবে। কাল বলে গেছে।’ একটু কৌতুহল হলো, মাশরাফি এদের বলে যায়? এবার অবাক সেই ছেলেটি, ‘আমাদের বলবে না কেন? মাশরাফি ভাই তো রানা ভাইয়ের ভাই।’
এই এক মজা, এক বিস্নয়। এলাকার লোকজন এত দিনে কেমন যেন বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছে মাশরাফি আসলে রানারই ভাই। মুজগুন্নিপাড়ায় ঢুকতেই ছোট্ট কয়েকটা চায়ের দোকান। এক দোকানদারের নাম আবার রানা। তাঁর ধারণা, মাশরাফি হলো ‘সাদা রানা’, ‘আমাগো রানা তো এট্টু কালা ছিল। কৌশিকের গায়ের রং ফরসা। এ ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নাই আমাগো কাছে। রানার মতোই আমাগো কাকা-কাকা করে ডাকে।’ একজন রানা খুঁজে পাওয়ার কী প্রাণান্ত চেষ্টা!
"܃܃"
একই দৃশ্য রানার বাসাতেও। এই যে এত বড় তারকা মাশরাফি, দেশবিদেশে যাকে এক পলক দেখার জন্য ভিড় জমে যায়, রানার বাড়িতে তাঁর আর আলাদা কোনো সত্তা নেই। এখানে রানার স্থান পূরণ করে যাওয়াই তাঁর কাজ। এসেই তাই বউকে নিয়ে সোজা রান্নাঘরে। মায়ের কোলের কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, ‘কী রান্ধো রাতে? গরুর মাংস! ভালোই হইছে।’ রান্নাঘরে মায়ের কাছে বউকে রেখে চলে আসে সে বসার ঘরে। রানার বাবা তখন দুই বহিরাগত সাংবাদিককে সামলাতে ব্যস্ত। মাশরাফির সেদিকে চোখ নেই, ‘ও কাকা, শরীরের কী অবস্থা।’ তারপর কত শত প্রশ্ন। এর মধ্যে মা আর মাশরাফির স্ত্রী ঢোকেন। এক সময় কথা ফুরিয়ে যায়। প্রায়ই যেখানে দেখা হয় সেখানে আর নতুন কথা কোত্থেকে তৈরি হবে! কথা মানে তো সেই রানা। সেই যন্ত্রণার কথা।
শর্তটা মাশরাফিই দিয়ে দিয়েছিল, ‘শোনেন দাদা, ও বাড়িতে যাবেন ভালো কথা। কিন্তু রানার কথা তুলে তুলে খোঁচানো যাবে না কিন্তু।’ দিবারাত্রি সাংবাদিকদের সামলাতে সামলাতে মাশরাফির এটুকু অভিজ্ঞতা অন্তত হয়েছে, সাংবাদিকেরা কষ্ট বোঝেন না! তাঁরা শুধুই খোঁচাতে জানেন। তবে এখানে আর প্রতিজ্ঞা ভাঙার দরকার হলো না। রানার কথা উঠেই গেল। আসলে রানার কথা না উঠে পারে কীভাবে?
রানার মায়ের এক পাশে বসে মাশরাফি আরেক পাশে মাশরাফির স্ত্রী। মাশরাফির চুলে হাত বোলাতে বোলাতে রানার মা বলছেন, ‘বাবা, তুমি মোটরসাইকেল নিয়ে আইছ? এট্টু সাবধানে চালাইও।’ ব্যস, উঠে গেল রানার কথা।
মাশরাফিই শুরু করলেন, ‘আমি সেলিমের কাছে শুনেছি। কী দুর্বিষহ সেই দৃশ্য! ওরা বারবার নিষেধ করছিল...।’ এরপর কি আর থেমে থাকে! চোখের জল আর সেই স্নৃতি বয়ে যায় অবিরাম। মাশরাফির চোখ দুটো লাল টক টক করছে, ‘রানাকে আমিও কতবার বলেছি, তুই ভাই জোরে গাড়ি চালাস না। শুনল না কোনো কথা।’ একটা বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস বের হয় রানার অসুস্থ বাবার, ‘নিয়তি। নিয়তিই টেনে নিয়ে গেছে ওকে।’ রানার মা কোনো কথা বলেন না। নীরবে কেঁদে চলেন। বিমূঢ় হয়ে মা-বাবা আর ছেলের মুখে স্নৃতিচারণা শুনে চলেছেন সুমনা।
রানার স্নৃতি সুমির ভান্ডারে তুলনামূলক একটু কম। কিন্তু যা আছে সেটাও খুব তরতাজা আর উচ্ছল, ‘এই তো সেদিন ওর (মাশরাফির) সঙ্গে প্রথম এলাম এই বাড়িতে। কী যে মজা করল রানা ভাই! আমাদের বিয়েতে তো একাই প্রায় মাতিয়ে রাখল।’ মাতিয়ে রাখার ব্যাপারে রানার কোনো জুড়ি ছিল এমন দাবি কেউ করতে পারে না। সুমি তাই সেই উচ্ছল রানাকে ভুলতেই পারেন না, ‘প্রথম যেদিন দেখা হলো সেদিনই কত রসিকতা করল।’
মাশরাফির স্ত্রীর পক্ষে রানার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্নৃতি খুঁজে বের করা কঠিন না। কিন্তু মাশরাফি যে মনেই করতে পারেন না, কবে প্রথম রানার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ‘আসলেই মনে করতে পারি না। আমরা তো সেই এতটুকু বয়স থেকে একসঙ্গে মিশি। আমার প্রথম ক্রিকেট বলে খেলা এই মাঠে...’ পেছনে হাত তুলে রানার বাড়ির পাশের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামটাকে দেখিয়ে দেন, ‘সে সময় থেকেই পরিচয়। তার পর থেকে আমার খুলনায় খেলতে আসা মানেই ওর বাসায় থাকা। তখন অবশ্য এই বাসাটা ছিল না।’ তখন রানারা যে বাসায় থাকতেন, সে বাসাটা প্রবেশপথেই দেখিয়ে দিয়েছেন মাশরাফিরা।
এবার কথায় যোগ দিলেন রানার মা, ‘কী যে করত ওরা। শুধু রানা আর কৌশিক তো না। এই সেলিম, শাওন, সেতু আরও কত জন। রাত-দিন হইচই।’ তারপর? তারপর সব হইচই মিলিয়ে একটা অসহনীয় নীরবতা। গুমোট একটা হাওয়া ঘিরে রেখেছে রানার বাসাটাকে। রানার মা চোখ মুছতে মুছতে সরে গেলেন। বললেন, ‘তোমাদের খাবার গোছাই।’ আসলে এই যন্ত্রণা থেকে একটু বাঁচতে চাইলেন!
মাশরাফি আর তাঁর স্ত্রী এবার চললেন রানার ঘরে। ঘরে ঢুকতেই হেলমেটটা চোখে পড়ল। একাকী পড়ে আছে শোকেসের ওপরে। হাতে ধরে গন্ধ শুঁকলেন মাশরাফি, ‘দেখলাম, আগের মতো ঘামের গন্ধটা আছে কি না।’ জোর করে হাসার একটা ভঙ্গি করলেন। হলো না। চোখ বেয়ে যে জল পড়ছে!
"܃܃"
খাবার টেবিলে আয়োজনে অন্যান্য খাবারের মধ্যে গরুর মাংসও আছে। রানার প্রিয় খাবার। এই খাবারের জন্যই ছিল সেদিনের ছোটা। মাশরাফি একবারে কয়েক টুকরো প্লেটে তুলে নিলেন। তাঁর স্ত্রী আবার সেগুলো কেড়ে নিলেন, মাশরাফির গরুর মাংস খাওয়া নিষেধ। রানার মায়ের কাছে স্ত্রীর এমন অন্যায় আচরণের অভিযোগ তুলছেন মাশরাফি। মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছেন। একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে গুমোট আবহাওয়া। মাশরাফি একটা করে কৌতুক বলছেন, হাসিতে ফেটে পড়ছেন সবাই। রানার বাসার হাওয়াটা একটু পাতলা হয়ে আসছে।
রানার মায়ের হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এসেছে, ‘এমনি করে খাবার টেবিলে বসত। বলত, মা খাইয়ে দাও। আরও কত সব গল্প খেতে বসে।’ আবার রানা চলে এল। রানাকে আটকে রাখার সাধ্য কার!
তথ্যসুত্র প্রথম আলো
__________________
Fire Lotta Kamal
|