View Single Post
  #49  
Old December 13, 2011, 09:47 PM
PoorFan PoorFan is offline
Moderator
 
Join Date: June 15, 2004
Location: Tokyo <---> Dhaka
Posts: 14,850


বিজয়ের ৪০ বছর: বিদেশি সহযোদ্ধা

পদগর্নির পত্র অন্ধকারে আলো

মফিদুল হক | তারিখ: ১৪-১২-২০১১


  • ০ মন্তব্য
  • প্রিন্ট
  • ShareThis




« আগের সংবাদ পরের সংবাদ»

  • নিকোলাই পদগর্নি
1 2




২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানি বাহিনী যে গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে, তা ছিল সুপরিকল্পিত অভিযান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পূর্বাপর মূল্যায়ন করে ‘পূর্ব বাংলা’ সমস্যার সামরিক সমাধানের পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করেছিল। উদ্যোগী হয়েছিল প্রায় হিটলারীয় ‘ফাইনাল সলিউশন’ বা চূড়ান্ত সমাধানে। সে জন্য আকস্মিক আঘাতে বিপুল রক্তপাত ঘটাতে সামরিক শাসকদের সামান্যতম দ্বিধা ছিল না। কেননা, তারা জানত, তাদের এই কাজের পেছনে মার্কিন তথা পশ্চিমা শক্তির সমর্থন রয়েছে এবং পাকিস্তানে যা কিছু ঘটবে, তা একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করার বাইরে কেউ যেতে পারবে না। কেননা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, সে ক্ষেত্রে এমনটাই ছিল সর্বপক্ষ-স্বীকৃত বিধান। ভারত যে হইচই করবে, তা মোকাবিলা করা দুষ্কর নয়। কেননা, একে ভারতের চিরন্তন পাকিস্তান-বিরোধিতা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে এবং শক্তিশালী ভারতের দিক থেকে যেকোনো কঠোর সমালোচনা দুর্বল প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ন্যক্কারজনক হস্তক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করে পাকিস্তান নিজেকে অন্যায়ের শিকার রূপে তুলে ধরতে পারবে। পরিস্থিতি বুঝে মাঝেমধ্যে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিলেই হবে, শান্তিপূর্ণ সমাধানে সরকার সচেষ্ট, ‘প্রকৃত’ জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে তারা আগ্রহী, বিচ্ছিন্নতাবাদীদ র কাছে নয়, এমন সব গোলমেলে বক্তব্য দিয়ে সামাল দেওয়া যাবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং তত দিনে রক্তবন্যায় ডুবিয়ে বাঙালিদের যথোচিত শিক্ষাদান সম্পন্ন হবে।
কিন্তু পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের নেতৃরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন শুরুতেই যে অসাধারণ প্রজ্ঞাবান ও মানবিক অবস্থান গ্রহণ করল, তা সরল পাকিস্তানি সমীকরণ বানচাল করে দেয়। গণহত্যা শুরুর পরপর ৩ এপ্রিল ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের কাউন্সিল অব মিনিস্টার্সের চেয়ারম্যান অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই পদগর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে এক পত্র প্রেরণ করে, যা ইতিহাসে ‘পদগর্নি লেটার’ হিসেবে অভিহিত হয়েছে। এই পত্রে নিকোলাই পদগর্নি কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে পাকিস্তানের সামরিক পদক্ষেপের প্রতি বিরূপতা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিপুল নির্বাচনী বিজয়ের উল্লেখপূর্বক তাঁর গ্রেপ্তারি ও পীড়নে উদ্বেগ ব্যক্ত করেন। তৎকালীন জটিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে যে লিপিকুশলতার সঙ্গে এই পত্র প্রণীত হয়েছিল, তা নিবিড় পর্যবেক্ষণ দাবি করে। তদুপরি এই পত্র ঘিরে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক তৎপরতাও বিশেষ উল্লেখ দাবি করে। সাধারণভাবে রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রেরিত পত্র কূটনৈতিক মাধ্যমে হস্তান্তরিত হয় এবং উভয় পক্ষের সম্মত সিদ্ধান্তে তা প্রকাশিত হয়। তবে গুরুতর ও জরুরি কোনো বিষয়ে পত্র একপক্ষীয়ভাবে প্রকাশের উদাহরণও রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রেরিত পত্র যে পরদিনের অর্থাৎ ৪ এপ্রিলের প্রাভদা পত্রিকায় প্রকাশিত হলো, সেটা এর গুরুত্ব তুলে ধরে। তদুপরি আরেকটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল সোভিয়েত বিদেশ মন্ত্রণালয়। ৫ এপ্রিল ১৯৭১ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সোভিয়েত মিশন ‘পদগর্নি পত্র’-এর কপি সব সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের দপ্তরে পৌঁছে দেয়।
এখানে পদগর্নি পত্রের কতক তাৎপর্যময় দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। ‘মান্যবর মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ সম্বোধনের পর কোনো রকম ভণিতা বা কুশলবিনিময় ছাড়াই লেখা হয়েছে, ‘ঢাকায় আলোচনা ভেঙে যাওয়া এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ ও চরম ব্যবস্থা অবলম্বন যে সামরিক প্রশাসন প্রয়োজন মনে করেছে, সেই সংবাদ সোভিয়েত ইউনিয়ন গভীর উদ্বেগের সঙ্গে গ্রহণ করেছে।’ এখানে কৌশলে ‘পাকিস্তান সরকার’ উল্লেখ না করে বলা হয়েছে ‘সামরিক প্রশাসন’, গণহত্যাযজ্ঞের সূচনার সেই ডামাডোলে যদি সমাজতান্ত্রিক শিবিরের চাপে শুভবুদ্ধির উদয় হয়, তবে পিন্ডির শাসকচক্র যেন সম্মানের সঙ্গে সমাধানে পৌঁছাতে পারেন, সেই অবকাশ তাদের দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ সরকার চাইলে নিজেকে রক্ষা করে দায়ভার চাপাতে পারতেন প্রাদেশিক বা তথাকথিত সামরিক প্রশাসনের ওপর।
এরপর সমস্যার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান কামনা করে বলা হয়, ‘মাননীয় প্রেসিডেন্ট, সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সোভিয়েতের সভাপতিমণ্ডলীর পক্ষ থেকে আমাদের কর্তব্য মনে করে আপনার প্রতি বিশেষ আবেদন জানাই, যেন আপনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর পীড়ন ও রক্তপাত ঘটানো বন্ধের জন্য অতীব জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।’ গণহত্যা বন্ধের জন্য এর চেয়ে জোরালো আবেদন আর ছিল না। ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েট মেজার্স’ বা যথাযোগ্য ব্যবস্থা কিংবা ‘আর্জেন্ট মেজার্স’ বা জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের বদলে বলা হয়েছিল ‘মোস্ট আর্জেন্ট মেজার্স’ এবং এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, যে-ভূমিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিকোলাই পদগর্নি স্বাক্ষরিত পত্র, যে পত্র মুক্তিযুদ্ধরত বাঙালিদের কাছে হয়ে উঠেছিল প্রেরণামূলক।
এরপর আগস্ট মাসে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা আরও মূর্ত রূপ নেয় এবং যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি তথা স্থিতাবস্থা আরোপের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয় সোভিয়েত ভেটো এবং সম্ভব করে তোলে বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
বাংলাদেশের মানুষের চরম দুর্দিনে পরম নির্ভরযোগ্য বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকার। আজ দেশটি আগের অবয়বে নেই, নামও গেছে পাল্টে, কমিউনিস্ট পার্টিও ক্ষমতাবিচ্যুত হয়ে এখন খণ্ড-বিখণ্ড, তবু তো রয়ে যায় ইতিহাস, সেই ইতিহাসের কাছে আমরা যতটা দায়বদ্ধ ততটাই ঋণী সোভিয়েত দেশ ও তার মানুষের কাছে, সেই মানুষদের তৎকালীন নেতৃত্ব, সরকার ও পার্টির কাছে এবং কৃতজ্ঞ নিকোলাই পদগর্নির কাছে, অনন্যসাধারণ ও তাৎপর্যময় এক পত্রের স্বাক্ষরদাতা হিসেবে।



Prothom Alo
Reply With Quote