View Single Post
  #27  
Old April 5, 2012, 08:31 PM
idrinkh2O's Avatar
idrinkh2O idrinkh2O is offline
Test Cricketer
 
Join Date: April 9, 2011
Favorite Player: Performing Tigers
Posts: 1,879

বস্তিবাসী শিশুগুলো যখন পরিসংখ্যান হয়ে যায়
ফারুক ওয়াসিফ | তারিখ: ০৩-০৩-২০১২


বস্তিজীবন সভ্যতার তলানিতে জমা গাদের মতো

শিশুটিকে প্রায়ই দেখি। যতটা কালো দেখায় ততটা কালো সে নয়। আমাদের জুতাগুলো প্রতিদিন রাস্তায় যত ময়লা রেখে আসে, সেগুলোয় মাখামাখি হওয়ায় তার মুখ আরও কালো দেখায়। সে রাস্তার শিশু। ফুটপাতটা তার এক টুকরা আঙিনা, সেখানে ঘুমায়, সেখানেই খেলে শিশু-খেলা। ঝাঁপিয়ে গিয়ে ওঠে মায়ের কোলে। মায়ের মুখটাও যতই কালিঝুলিতে ঢাকা থাক, বাচ্চার জগৎ-ভোলানো হাসির টানে সেও ভুবনমোহিনী হাসি না হেসে পারে না। মায়ের এই কোলটা ছাড়া আর কিছু নেই শিশুটার। আর সব ভীষণ রাস্তাঘাট, নিষ্ঠুর পুলিশ-সরকার। আর আছে ফুটপাত আর বস্তিতে বেড়ে ওঠা শিশুদের জন্ম-মৃত্যুর পরিসংখ্যান। ওই সব পরিসংখ্যানের একটি সংখ্যা হওয়া থেকে রেহাই পেতে হলে শিশুটিকে বেঁচে থাকতে হবে। কঠিন এক শীত চলে গেল, পিচ গলানো গরম আসছে, সঙ্গে আসছে বস্তি-ফুটপাত ডোবানো বর্ষা আর নোংরা গদগদে কাদা-জীবাণু আর অভাব। এত সব পেরিয়ে কি বেঁচে থাকতে পারবে শিশুটি?

ওদের দেখা পাই সাধারণত সন্ধ্যার পর, কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে। দিনের বেলা তারা কই যায়, কী করে, তার হদিস পাওয়া মুশকিল। রাত যত বাড়ে, ততই ঢাকা শহরের ফুটপাত, ওভারব্রিজ, সড়কদ্বীপ, অফিস ভবনের খোলা বারান্দা ভরে ওঠে এসব কালো কালো ভুতুড়ে মানুষ দিয়ে। সংখ্যা গুনতে হলে সেটাই উত্তম সময়।

কিছুদিন হলো ওই শিশুটিকে আর দেখি না—অন্য শিশু দেখি, অন্য মা দেখি, ফুটপাতবাসী অন্য নারী-পুরুষ দেখি। আর কেবল পরিসংখ্যান দেখি। ইউনিসেফের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে শহরের বস্তি এলাকার শিশুমৃত্যুর হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সব দিক থেকেই তাদের অবস্থা গ্রামের গরিব শিশুদের থেকেও খারাপ। শহুরে বস্তিতে এক হাজার জীবিত জন্মানো শিশুর ৯৫ জনই মারা যায়, গ্রামে মারা যায় ৬৬ জন। গ্রামে প্রাক্-প্রাথমিকে ভর্তি হয় ২২ শতাংশ, বস্তিতে হয় তার অর্ধেক। শহর ও গ্রামে ৮০ শতাংশ শিশু পঞ্চম শ্রেণীতে পৌঁছায়, বস্তিতে তাদের হার ৪৮ শতাংশ। গত বৃহস্পতিবারের প্রথম আলোয় ওই পরিসংখ্যানের সঙ্গে এটাও বলা হয়েছে, বস্তির বঞ্চিতদের মধ্যে শিশুরা বঞ্চিততম। এবং তারা বাধ্য দুনিয়ার সব থেকে কম মূল্যে গতর খাটাতে। বস্তিতে সবই কম, বহু বন্দিত ও প্রচারিত ‘মহান মানবতা’ও সেখানে ঢুকতে গিয়ে মুমূর্ষু হয়ে পড়ে। মানবতা, উন্নয়ন, সভ্যতা, আধুনিকতার মতো চকচকে ব্যাপারগুলো তাই বস্তির গা বাঁচিয়ে চলে। বদলে তারা হাজির করে পরিসংখ্যান, শিশুমৃত্যুর পরিসংখ্যান, না খাওয়া ও রোগে ভোগা জীবনের টলায়মানতার পরিসংখ্যান। হয়তো এ রকম শুকনা পরিসংখ্যানের মধ্যেই হারিয়ে গেছে আমার দেখা ওই শিশু ও তার মা।

এদের জীবন নিয়ে স্লামডগ মিলিয়নিয়ার-এর মতো মিলিয়ন ডলার কামানো ছবি অথবা বস্তির রাজা টাইপের সিনেমা হতে পারে, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মসূচি চলতে পারে, বস্তির লোকের নেতা বা গডফাদার হয়ে ক্ষমতার খুঁটি পোক্ত করা যেতে পারে; কিন্তু এই জীবনকে ভালোবাসা যায় না। এই জীবন মানুষের না, এই জীবন মানুষের পক্ষে যাপন করা প্রায় অসম্ভব। কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছিলেন, এই বস্তিবাসীরা যে পানি পান করে তা দিয়ে ভদ্রলোকেরা এমনকি শৌচকাজ করতেও রাজি হবে না।

অর্থনীতির দোষে তারা গ্রামের জমিজমা ও সমাজ দুটোই খুইয়ে বসেছে, আর এদিকে রাষ্ট্র তাদের পরিত্যাগ করেছে। পরিত্যক্ত হলেও তো তারা জন্মসূত্রে মানুষ। সেই সূত্রেই বস্তি নামক হাবিয়া দোজখে তারা আবার সমাজ গড়ে তোলে, পরিবার পত্তন করে। সেখানে নতুন এক সংস্কৃতিও দিনে দিনে চেহারা পায়। আনন্দ-শোকে, প্রেমে ও বিবাদে, দলাদলি আর এজমালি ব্যাপারে সেই সংস্কৃতির জীবনবাদিতার জোর একেবারে কম নয়। কিন্তু এদের এই মৃত্যু ও দারিদ্র্য ঠেকানোর যুদ্ধ, এদের এই একত্রে থাকার সামাজিকতা সরকার মহাশয়ের দরবারে কোনো দামই পায় না।

সরকারি হিসাবে দেশে ৭০ লাখ মানুষ বস্তিবাসী, বাস্তবে তা কোটি হবে। একাত্তরে এই পরিমাণ মানুষই সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থী হয়েছিল। স্বাধীন দেশে সেই পরিমাণ মানুষই সারা দেশ থেকে ভিটামাটি ও জীবিকা হারিয়ে বস্তি নামক অভ্যন্তরীণ শরণার্থী শিবিরের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে। শরণার্থীরা তাও ত্রাণ পায়, স্বীকৃতি পায়, তাদের দায় নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে রাষ্ট্রের বা জাতিসংঘের। কিন্তু বস্তিবাসীদের বেলায় সবাই নিদায়। তারা রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্রহীন নৈনাগরিক। এই নৈনাগরিকদের জন্য রাষ্ট্র একমাত্র যে সেবাটি পাঠায়, তা দিতে আসে উচ্ছেদের বুলডোজার আর পুলিশের লাঠি। ভুলে যাওয়া হয়, শহরটা তাদেরও, দেশটাও তাদের।

বস্তিবাসীদের সিংহভাগই থাকে ঢাকায়। ঢাকাই এ দেশের রাজধানী, রাষ্ট্রের যাবতীয় শৌর্যবীর্য মহানুভবতার প্রদর্শনী মঞ্চ। অথচ এই শহরভিত্তিক শক্তিমান রাজনৈতিক দলগুলোর এদের ব্যাপারে কোনো কর্মসূচি নেই, দাবিদাওয়া নেই। গরিব-ভূমিহীন আর বস্তিবাসীদের কোনো স্থান রাজনীতির আলোচনায় অথবা উন্নয়নের বাহারি পরিকল্পনায় নেই। পরিসংখ্যান, গবেষণা আর এনজিও-রচনাগুলোর যদিও প্রধান চরিত্র এরা, তবু এসব পথে যে দারিদ্র্য ঘুচবে না, গত ৪০ বছরের সরকারি ও এনজিও কর্মসূচিগুলো নিজেরাই তা প্রমাণ করেছে। তাহলে এদের কী হবে? এদের জন্য একটাই সুযোগ, যেভাবে পারো ক্ষুধা ভুলে মুখের হাঁ একদম সেঁটে, চোখ-কান-নাক বন্ধ করে মনকে ঠেসে, মল-মূত্র ত্যাগের রাস্তায় ছিপি এঁটে শ্রেফ গায়েব হয়ে যাও, নাই হয়ে যাও। তোমরা বেঁচে থাকবে কেবল পরিসংখ্যানে আর ভোটার তালিকায়।

পরিসংখ্যানে যা কেবল সংখ্যা, বাস্তবে তা একেকটি জীবন। সেই জীবনে আর সবার মতোই ভাত-কাপড়-ঘর ও আপনজনের দরকার হয়। এবং সেই জীবন আর সবার মতো একটাই; একবার গেলে বা প্রাণিসুলভ দশায় পড়লে পরে তো আর বদলানোর সুযোগ নেই।

বস্তিজীবন সভ্যতার তলানিতে জমা গাদের মতো, অনেক জমলে পরে তা পরিষ্কার করা হয়। মাঝেমধ্যে বস্তি উচ্ছেদের মাধ্যমে, ‘ভবঘুরে ও আশ্রয়হীন ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন ২০১০’-এর ফেরে ফেলে সেটা করও হয়। এই আইন ‘ভবঘুরে এবং আশ্রয়হীন ব্যক্তি’দের ওপর পুলিশের স্বেচ্ছাচারী হওয়ার রক্ষাকবচ। রাজনৈতিক সহিংসতার সময় গরিব লোক দেখে দেখে ধরে জেলে ভরা হয়। দেশের কারাগারগুলোতেও তাদের গাদাগাদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তারপর মামলা-জামিনের সুড়ঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তারা আরও গরিব হয়ে যায়, কেউ কেউ ভিখারিও হয়। গরিববিরোধী আইন এভাবে গরিবি বাড়ায়। আর কোনো শ্রেণী বা পেশার বিরুদ্ধে এ রকম আইন নেই।

কিন্তু কেন এরা ভবঘুরে বা আশ্রয়হীন? ক্ষুদ্রঋণের সাফল্যের জয়গান যখন দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় বাজে, তখন এরা সশরীর উপস্থিতি প্রমাণ করছে, ক্ষদ্রঋণের দেশে ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য কমাতে ব্যর্থ। ব্যবসা ও মুনাফার চোং দিয়ে সারা দেশ থেকে বিপুল সম্পদ যে হারে ঢাকায় জমছে, সেই হারেই সারা দেশের সম্পদ ও জীবিকা হারানো মানুষ ঢাকায় মজুদ হচ্ছে। যে মুক্তবাজারি অর্থনীতি, যে সড়ক-ইমারতকেন্দ্রিক উন্নয়ন-তরিকা, যে ভোটশোষণের গণতন্ত্র চালু আছে বাংলাদেশে, তারও বড় শিকার এই শিশুরা। নির্বাচিত বা সামরিক বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো যখন সর্বদাই গরিবের বিরুদ্ধে, তখন কেতাবি গণতন্ত্র আসে বটে, কিন্তু রাংতার মতো তার উল্টো পিঠটা ফাঁকাই লাগে।

শুনছি, ৪৫ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে এক আলিশান নতুন ঢাকা গড়া হবে। ঘোড়ারোগ গরিব দেশের সরকারগুলোরই হয়। কিন্তু এমন গরিব সরকার কবে হবে, যে এশিয়ার বৃহত্তম শপিং মল কিংবা বৃহত্তম বিমানবন্দরের চেয়ে, অপ্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র কেনার চেয়ে কোটি কোটি গরিবের দিনবদলের কর্মসূচি আনবে।

দেশের সব খাস ও পরিত্যক্ত জমি, নতুন জাগা চরাঞ্চল আবাসন কোম্পানিগুলোর গ্রাস থেকে বাঁচিয়ে, জবরদখলকারীদের থেকে উদ্ধার করে ভিটাহীন ও নদীসিকস্তি মানুষদের বন্দোবস্ত দিতে চাইবে। শহরে কলকারখানায় তাদের কর্মসংস্থান করে এবং গ্রামাঞ্চলে কৃষি ও কৃষকের নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়াকে আঁটো করতে পারলেও ভূমিহীনদের শহরমুখী অভিবাসন কিছুটা কমতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রাম-শহরের এসব অপবর্গীয় মানুষদের কোনো কণ্ঠস্বর বা প্রতিনিধিত্ব যখন নেই, তখন সংসদে কারা এসব দাবি তুলবে, কারা রাজপথে হাঁক দিয়ে বলবে ‘বস্তিওয়ালা জাগো’। এটুকু করার জন্য সেই সরকারকে বিপ্লবী হওয়া লাগবে না, কেবল একটু মানবিক হতে হবে, আর মানুষকে পরিসংখ্যান না ভেবে, ভাবতে হবে মানবসমাজ। ক্ষমতাসীনেরা যে এসব ভাবে না, তার কারণ বাদবাকি যারা শিক্ষিত-সুশীল-সচ্ছল, তারাও মানবিক সমাজের জন্য ক্ষুধার্ত নয়। এই অবস্থা সমাজের খোপে খোপে বঞ্চনার মাইনফিল্ড সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্রের গোদা পা পড়লে হঠাৎ যে এসব মাইনফিল্ড বিস্ফোরিত হবে না, তা কে বলতে পারে?

Source: http://www.prothom-alo.com/detail/da...03/news/229346
__________________
-- Alwayz with !!! Champions are made from something they have deep inside them - a desire, a dream, and a vision!
-- Bangladesh are the Runners-up in the 2012 ASIA Cup!
Reply With Quote