View Single Post
  #47  
Old December 8, 2011, 08:45 PM
PoorFan PoorFan is offline
Moderator
 
Join Date: June 15, 2004
Location: Tokyo <---> Dhaka
Posts: 14,850


বিজয়ের ৪০ বছর: বিদেশি সহযোদ্ধা

সিডনি শনবার্গ: একাত্তরের ভাষ্য জেনোসাইডের সাক্ষ্য

মফিদুল হক | তারিখ: ০৯-১২-২০১১


  • ০ মন্তব্য
  • প্রিন্ট
  • ShareThis




« আগের সংবাদ পরের সংবাদ»
  • সিডনি শনবাগ
1 2




কত সাংবাদিক কতভাবেই না জড়িত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে, তাঁদের অনেকের রিপোর্টিং-জীবনে সেটা ছিল চার্চিল কথিত ‘ফাইনেস্ট আওয়ার’। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে গণমাধ্যমে বৈদেশিক সংবাদদাতা হয়ে উঠছিল আলোচিত চরিত্র। ভিয়েতনাম যুদ্ধ জন্ম দিয়েছিল নতুন এক সাংবাদিকতার, যুদ্ধবিরোধী গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন পৃথিবীর স্বপ্নও যেন দেখতে শুরু করেছিল অযুত মানুষ। ভিন্ন এক উন্মাদনায় অধীর বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সৃষ্টি করেছিল বিপুল অভিঘাত। ফলে বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে যাঁরা বাংলাদেশের ঘটনাধারা অনুসরণ করেছিলেন, তাঁদের সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনে নিষ্পৃহতা মুছে দিয়েছিল একধরনের সহমর্মিতা ও অঙ্গীকারের বোধ।
এমন অনেক সাংবাদিকের একজন সিডনি শনবার্গ, একাত্তরের মার্চে যাঁরা ঢাকায় ছিলেন এবং ২৫ তারিখ ঢাকা থেকে বিতাড়িত হন, তাঁদের অন্যতম নিউইয়র্ক টাইমস-এর এই সংবাদদাতা। সিডনি শনবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট সম্পন্ন করে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন নিউইয়র্ক টাইমস-এ। কপি বয়, ডেস্ক রাইটার ইত্যাদি নানা কাজে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে ১৯৭১ সালে তিনি পত্রিকার দিল্লি অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তরুণ এই সাংবাদিকের জন্য বাংলাদেশবিষয়ক রিপোর্টিং ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ। ঢাকা থেকে বহিষ্কৃত হলেও তিনি অচিরে দিল্লি ফিরে আসেন এবং যেমন দিল্লি থেকে তেমনি সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুরেও সংবাদ সংগ্রহ করেন। মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের আগেই আগরতলায় সরকার গঠিত হওয়ার সংবাদ প্রথম তিনি প্রকাশ করেন। খালেদ মোশাররফের গেরিলা দলের সঙ্গে তাদের অপারেশনে দেশের ভেতরে তিনি প্রবেশ করেন। জুন মাসে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ নিয়মকানুন শিথিল করে বিদেশি সংবাদদাতাদের ঢাকায় আসার অনুমোদন দিলে সিডনি শনবার্গ সেই সুযোগ গ্রহণ করেন বটে, তবে তাঁর রিপোর্ট কর্তৃপক্ষের মনঃপূত না হওয়ায় অচিরেই আবার বহিষ্কৃত হন। ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতা থেকে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে মুক্ত বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়বরণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাধারার পূর্বাপর ও ধারাবাহিক রিপোর্টিংয়ের ঐতিহাসিক সুযোগ সিডনি শনবার্গের করায়ত্ত হয়েছিল।
আজ ৪০ বছর পর সেই সব রিপোর্টের দিকে ফিরে তাকালে এর সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা দেখে পুনরায় হতে হয় বিস্মিত ও অভিভূত। সিডনি শনবার্গ ও বিদেশি সংবাদদাতাদের অধিকাংশ রিপোর্ট মার্কিন কংগ্রেশনাল রেকর্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এডওয়ার্ড কেনেডি ও অন্য কংগ্রেস সদস্যদের বক্তব্যের সুবাদে। এই সব দলিল ইতিহাসের অন্তর্গত। ৪০ বছর পর ইতিহাসের দায়মোচনে বাংলাদেশ যখন প্রবেশ করেছে, ‘জেনোসাইড’ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তখন বিদেশি সংবাদদাতাদের বিভিন্ন রিপোর্ট অর্জন করেছে আরেক মহিমা।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একাত্তরে সংঘটিত নৃশংসতা ও বর্বরতা আইনি দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করবেন এবং সে ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর বিরুদ্ধে দুই ধরনের অর্থাৎ জেনোসাইড ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আদালতে গৃহীত হয়েছে। সংগঠিত ও ব্যাপকভাবে যেসব হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন ঘটেছে, তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং সুনির্দিষ্টভাবে কোনো জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে গোষ্ঠীর সদস্যদের পুরোপুরি বা আংশিকভাবে উৎখাত বা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্যে যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে, তা জেনোসাইড হিসেবে বিবেচিত হবে। আদালত সর্বাগ্রে বিবেচনা করবেন বাংলাদেশে একাত্তরে জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছিল কি না, তারপর বিবেচিত হবে সেই জেনোসাইডে অভিযুক্ত সাঈদীর সম্পৃক্ততা ছিল কি না।
হিন্দু জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করার লক্ষ্য নিয়ে আদৌ কি পরিচালিত হয়েছিল জেনোসাইড—এই নিয়ে আদালতে চলবে সওয়াল-জবাব, আদালতের বাইরেও চলবে আলোচনা। এখানে সাক্ষ্যভাষ্য হিসেবে বিদেশি সংবাদদাতাদের রিপোর্ট পালন করবে বিশাল ভূমিকা। এ ক্ষেত্রে সিডনি শনবার্গের রিপোর্ট থেকে কিছু উদ্ধৃতি লোকসমাজের সামনে সাক্ষ্য হিসেবে আমরা পেশ করতে পারি। জুন মাসে ঢাকায় এসে সরেজমিনে বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে তিনি কয়েকটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন। ২৫ জুন, ১৯৭১ প্রকাশিত রিপোর্টে লিখেছিলেন: ‘হিন্দু সংখ্যালঘিষ্ঠরা বিশেষভাবে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যে ছয় লাখ পূর্ব পাকিস্তানি ভারতে পালিয়ে গেছে, তাদের ভেতর চার লাখ বা ততোধিক হচ্ছে হিন্দু। হিন্দু অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান যারাই পালিয়ে গেছে, তাদের বাড়িঘর দিয়ে দেওয়া হচ্ছে “অনুগত” নাগরিকদের।’
সিডনি শনবার্গ সে-যাত্রায় ফরিদপুরে গিয়েছিলেন এবং ২৯ জুন, ১৯৭১ প্রকাশিত রিপোর্টে লেখেন, ‘সংঘর্ষক্ষেত্রে কর্মরত একজন আর্মি কমান্ডার ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সময় স্বীকার করেন, তাঁদের নীতি হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংস করা, হিন্দু ও মুসলমান উভয়কে, বিশেষভাবে হিন্দুদের, উৎখাত করা। ফরিদপুরে এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় গোটা পরিধিজুড়েই, সেনাবাহিনী আসার আগে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। আর্মি এখন এমন বিরোধ উসকে দিতে চাইছে। এপ্রিল মাসে জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ফরিদপুর শহরকেন্দ্রে দুজন হিন্দুর শিরশ্ছেদ করে তাঁদের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকজন হিন্দু যখন প্রাণ বাঁচাতে ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে আবেদন জানায়, তাদের কাফের গণ্য করে গুলি করে মারা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য ধর্মান্তরিত হওয়া গৃহীত হয়ে থাকে।’
এই রিপোর্ট প্রকাশের পর পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ সিডনি শনবার্গকে পুনরায় বহিষ্কার করে। সিডনি শনবার্গ এরপর ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ট্যাংকে সওয়ারি হয়ে, তাঁকে বহিষ্কারের ক্ষমতা যখন আর পাকিস্তান বাহিনীর ছিল না।
৪০ বছর পর সত্যের সওয়ারি হয়ে সিডনি শনবার্গের রিপোর্ট আজ আবার প্রতিধ্বনিত হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কক্ষে এবং কক্ষের বাইরে। বিদেশি সংবাদদাতার এই সব রিপোর্টের সত্যতা মোচন বা অস্বীকার করার সাধ্য কারও থাকবে না—এই প্রত্যাশা নিশ্চয় আমরা করতে পারি।


Prothom Alo
Reply With Quote