View Single Post
  #53  
Old December 16, 2011, 12:13 AM
PoorFan PoorFan is offline
Moderator
 
Join Date: June 15, 2004
Location: Tokyo <---> Dhaka
Posts: 14,850


জেনারেল জ্যাকবের সাক্ষাৎকারের তৃতীয় ও শেষ কিস্তি আজ ছাপা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।

জেনারেল জ্যাকব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আত্মসমর্পণের জন্য কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে, তার সবটাই ছিল আমার চিন্তাপ্রসূত। আমি দিল্লিতে যে খসড়া দলিল পাঠিয়েছিলাম, তার ভিত্তিতেই নিয়াজির সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছিলাম। চার ঘণ্টার মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতিকে রূপান্তর করা হয়েছিল প্রকাশ্য আত্মসমর্পণে। নিয়াজির আরও দুই থেকে তিন সপ্তাহ যুদ্ধ চালানোর ক্ষমতা ছিল। হামুদুর রহমান কমিশনের সামনে নিয়াজিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি শুধু আত্মসমর্পণই নয়, তিনি এক লজ্জাজনক প্রকাশ্য আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে সম্মত হয়েছিলেন। এমনকি গার্ড অব অনার দিতেও তাঁকে রাজি হতে হয়েছিল।’
প্রথম আলো: ঢাকায় ওই সময় ১০ জন পাকিস্তানি সেনার বিপরীতে ঢাকার বাইরে মাত্র একজন ভারতীয় সেনা ছিল। সেটা আপনি নিয়াজিকে বুঝতে দেননি।
জেনারেল জ্যাকব: নিয়াজি সব সময় মুক্তিবাহিনীর হামলার ভয়ে শঙ্কিত ছিলেন। তাঁরা যখন আত্মসমর্পণে রাজি হচ্ছিলেন না, তখন একপর্যায়ে বললাম, এটা মানতে আপনাদের ৩০ মিনিট সময় দিলাম। এর মধ্যে যদি সিদ্ধান্ত না নিতে পারেন, তাহলে আমি পুনরায় যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ দেব। ঢাকা সেনানিবাসে বোমা ফেলারও হুকুম দেব। এ কথা বলে আমি নিয়াজির কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলাম। এরপর আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণ তখন আমার জানা ছিল না, আমার প্রস্তাব নিয়াজি নাকচ করলে আমি কী করব! তখন অরোরার এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় এসে পৌঁছার কথা। অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির সময় ফুরিয়ে আসতেও তখন আর বেশি বাকি নেই। আমি শুধু আশা করছিলাম, মানেকশর কাছে আমি যে খসড়া পাঠিয়েছিলাম, সেটাই যেন তিনি অনুমোদন করে নিয়ে আসেন। সেই বৈরী পরিস্থিতিতে আমি ছিলাম একা। বিবিসি এবং অন্য যারা ছিল, তারা ঘুরেফিরে আমাকে নানা প্রশ্ন করছিল। কিন্তু আমার কাছে উত্তর ছিল না।
প্রথম আলো: ওই ৩০ মিনিটে আপনি কী করেছিলেন?
জ্যাকব: আমি একজন পাকিস্তানি দ্বাররক্ষীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাঁর ব্যক্তিগত ভালো-মন্দের খোঁজ নিয়েছিলাম। একপর্যায়ে তিনি কেঁদে ফেললেন। বললেন, তাঁর নিজের কর্মকর্তাদের কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন না। কিন্তু একজন ভারতীয় হয়ে তিনি তাঁর খোঁজখবর নিলেন। ৩০ মিনিট পর আমি কক্ষে ঢুকলাম, সেখানে তখন কবরের নিস্তব্ধতা।
কাগজটি টেবিলের ওপর পড়ে আছে। জেনারেল, আপনি কি এটা গ্রহণ করছেন? আমি তাঁকে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলাম, তিনি নীরব। আমি তাঁকে তৃতীয়বার একই প্রশ্ন করলাম, নিয়াজি নীরব। তখন আমি ছোঁ মেরে টেবিল থেকে কাগজটি তুলে নিলাম। গলার স্বর একটু উঁচু করে বললাম, আমি ধরে নিচ্ছি, আপনি এটা গ্রহণ করেছেন।
প্রথম আলো: নিয়াজি বলেছেন, আত্মসমর্পণ করাতে আপনি তাঁদের মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।
জ্যাকব: একদম বাজে কথা। আত্মসমর্পণ না করলে তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছিলাম। এটা একটা চাপ ছিল। কিন্তু আমি বলিনি যে, তাঁদের হত্যার জন্য মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। আমি বলেছি, আমি দায়িত্ব নেব না।
প্রথম আলো: রেসকোর্সের ধারণাটি কী করে এল? নিয়াজির কী প্রতিক্রিয়া ছিল?
জ্যাকব: আমি চেয়েছিলাম, বাংলার জনগণকে তারা যে অবর্ণনীয় নির্যাতন ও দুঃখ-কষ্ট দিয়েছে, তারা এর সাক্ষী থাকুক। আমি যখন বলেছিলাম, আত্মসমর্পণে আপনাদের সম্মতি আমি ধরে নিচ্ছি, তখন জেনারেলরা ঘোঁতঘাত শব্দ করলেন। আমি পুনরায় নিয়াজিকে একটু তফাতে ডাকলাম। বললাম, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে বাংলাদেশের জনগণের সামনে। রেসকোর্স ময়দানে এবং সেখানে তাঁকে তাঁর তরবারি সমর্পণ করতে হবে। তিনি জোরালোভাবে রেসকোর্সে যেতে আপত্তি তুললেন। নিয়াজি বললেন, আত্মসমর্পণ এখানেই হবে। আমি বললাম, আমি ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে ফেলেছি। এখন আর এটা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। শুনে তিনি বললেন, তাঁর কোনো তরবারি নেই। আমি বললাম, পিস্তল দিলেই চলবে। নিয়াজি তা-ই দিয়েছিলেন। অরোরার হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার সময় তাঁর চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল।
প্রথম আলো: সেই পিস্তলটি এখন কোথায়?
জ্যাকব: দেরাদুনে অবস্থিত ভারতীয় সামরিক একাডেমিতে।
প্রথম আলো: ওই অনুষ্ঠান কেমন হয়েছিল?
জ্যাকব: সাদামাটা অনুষ্ঠান ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল। সইয়ের পরে নিয়াজি প্রায় গণপিটুনির শিকার হতে চলেছিলেন। আমরা তাঁকে আমাদের জিপে করে নিরাপদে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমি তখন জেনারেল স্বাগত সিংকে নিয়ে বাকি পরিকল্পনা গ্রহণ করি। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় কলকাতার উদ্দেশে আগরতলা রওনা দিতে আমরা বিমানবন্দরে যাই। কলকাতায় যখন পৌঁছাই, তখন রাত ১০টা। রাত ১১টায় অফিসে গিয়ে পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে বার্তা পাঠাই দিল্লিতে। তবে আমার বাসায় আমার জন্য তখনো এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। মধ্যরাতের কাছাকাছি আমি বাসায় গিয়ে দেখি, অপেক্ষা করছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক নিকোলাস টমালিন। তিনি ঢাকায় যেতে পারেননি। টমালিনের অনুরোধে আমি পুরো ঘটনা তাঁকে খুলে বলি।
প্রথম আলো: বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে ১৬ ডিসেম্বরে কী ঘটেছিল?
জ্যাকব: দুপুরের ভোজ শেষে নিয়াজির গাড়িতে চড়েই জেনারেল অরোরাকে অভ্যর্থনা জানাতে আমি বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম। কারণ, নাগরা আমার জন্য কোনো জিপ রেখে যায়নি। পথে আমাদের গাড়িতে একদল মুক্তিযোদ্ধা লাফিয়ে উঠলেন। আমি তাঁদের অনুরোধ করলাম, যাতে আমাদের যেতে দেওয়া হয়। ঘুরপথে আমার নজরে এল, আমাদের দুজন ছত্রীসেনা একটি গাড়িতে করে টহল দিচ্ছে। আমি তাদের আমাদের গাড়ি অনুসরণ করতে বললাম। বেলা চারটা ১০ মিনিটে আমরা এয়ারফিল্ডে পৌঁছালাম। একটু পরই আমাদের মতোই জলপাই রঙের উর্দি পরা একজন এগিয়ে এলেন। তাঁর কাঁধে একজন ভারতীয় মেজর জেনারেলের ব্যাজ শোভা পাচ্ছে। তাঁর পেছনে দুজন সশস্ত্র ব্যক্তি। আমি তাঁকে বাঘা সিদ্দিকী হিসেবে শনাক্ত করি। এক ট্রাকবোঝাই মুক্তিবাহিনীও তাঁর পেছনে এল। তাঁর নেতৃত্বে থাকা ২০ হাজার যোদ্ধা টাঙ্গাইলে পাকিস্তানি সেনাদের হটাতে একটি বুলেটও খরচ করেনি। এমনকি ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে তিনি ঢাকা অভিমুখের যাত্রায় শামিল হননি। আমি বিপদের গন্ধ পেলাম। বুঝলাম, তিনি নিয়াজিকে হত্যা করতে এসেছেন। নিয়াজিকে তখন বাঁচিয়ে রাখতেই হবে, নইলে যে আত্মসমর্পণ ভেস্তে যাবে। তাঁকে হত্যা করা হলে আত্মসমর্পণ হতো না। আমি দুই ছত্রীসেনাকে বললাম সিদ্দিকীর দিকে রাইফেল তাক করে রাখতে। আমি প্রথমে বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে যেতে বলি। তিনি তাতে সাড়া দেননি। আমি তখন চিৎকার করে তাঁকে এলাকা ত্যাগ করতে বলি। তিনি রাগ করে স্থান ত্যাগ করেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
প্রথম আলো: একাত্তরের ভূমিকার জন্য আপনার স্বীকৃতি বিষয়ে বলুন।
জ্যাকব: ইহুদিদের প্রতি পাকিস্তানিদের কোনো প্রেম নেই। কিন্তু তাদের প্রতিরক্ষা কলেজের দলিল বলছে, ‘মূল কৃতিত্ব (১৬ ডিসেম্বরে বিজয়) স্পষ্টতই জ্যাকবের পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রস্তুতিকেই দিতে হবে।’
প্রথম আলো: ভারতের তরফে...
জ্যাকব: আমার প্রথম বই সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা ১৯৯৭ সালে বেরোয়। তখন আমি মানেকশ ও অরোরাকে কপি দিয়েছিলাম। তাঁদের দ্বিমত করতে দেখিনি। পরে ইতিহাস লেখার জন্য ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের একটি দল একটা দায়সারা সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। পরে শুনেছি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক আমার বক্তব্য বাদ দিয়ে মানেকশর বয়ান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
প্রথম আলো: জনসমক্ষে ইতিহাসের প্রথম আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের রূপকার হিসেবে আপনি তাহলে যথাস্বীকৃতি পাননি।
জ্যাকব: না, আমি সেটা বলতে চাই না। একজন সৈনিক হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছিলাম। ওটা আমার চিন্তার বিষয় নয়। (শেষ)



Prothom Alo
Reply With Quote