মাথার ওপর থেকে পাহাড় সরে গেছে - সাকিব
সাকিব আল হাসান
‘মাথার ওপর থেকে পাহাড় সরে গেছে’
উৎ পল শুভ্র | তারিখ: ১৩-০৩-২০১১
ম্যাচের পর তো বলেছিলেন, আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না। ১৮-১৯ ঘণ্টা পর এখন কী মনে হচ্ছে?
সাকিব আল হাসান: মনে হচ্ছে, মাথার ওপর থেকে একটা পাহাড় সরে গেছে। পুরো দেশের চাপ সরে গেছে।
যদি একটু নাটকীয়ভাবে জিজ্ঞেস করি, কী করিয়া এই অসম্ভব সম্ভব হইল?
সাকিব: কী করিয়া সম্ভব হইল...(হাসি)... তামিম আর ইমরুল যখন শুরুটা ভালো করল, ২-৩ ওভার হওয়ার পর আমি ড্রেসিংরুমটা ভালো করে দেখলাম। সাধারণত যেটা হয়, চার-টার হলে দর্শকেরা তালি দেয়, ড্রেসিংরুমে তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না। কিন্তু এ দিন দেখি, সবাই একটু লাফাচ্ছে। তখনই মনে হয়েছে, দলের মধ্যে জয়ের তীব্র একটা ইচ্ছা আছে। এসব জেতার লক্ষণ।
বাংলাদেশ তো বড় দলের বিপক্ষে এর আগে কোনো দিন এভাবে জেতেনি। একটা কারণ বলতে বললে সেটি কি ওই জয়ের সুতীব্র ইচ্ছা?
সাকিব: বলতে পারেন। এমনকি যাঁরা খেলেননি, তাঁদের কথাও খুব কাজে এসেছে। অন্যদের কথা বলতে পারব না, কারণ একেকজন একেকভাবে ইন্সপায়ার্ড হয়। নিজের কথা বলতে পারি, আমি ওদের কথায় খুব ইন্সপায়ার্ড হয়েছি।
কী বলেছেন ওঁরা? দু-একটা কথা কি বলা যায়?
সাকিব: শুভ ভাই খুব ভালো কথা বলেছেন, আশরাফুল ভাই-আবীর (শাহরিয়ার) ভাই, নাজমুল ভাইও। একজ্যাক্টলি কী বলেছেন, সেটি মনে নেই। তবে চারজনের কথা থেকেই আমি ইন্সপায়ার্ড হয়েছি। ওনাদের মধ্যে জয়ের ইচ্ছাটা অনেক বেশি ছিল।
বিশ্বকাপের আগে বলছিলেন, আপনার টস-ভাগ্য ভালো নয়। অথচ এই বিশ্বকাপে তো মনে হচ্ছে, সাকিব আল হাসান টস জিতবেন—আইসিসি এটা আইন করে দিয়েছে...
সাকিব: বুঝলাম না...চারটি ম্যাচেই টস জিতলাম (হাসি)। যদিও আমি কল করছি না। আমি টস করছি, ওরা কল করছে আর হারছে।
কখনো কখনো কি মনে হয়, টস না জেতাই ভালো। তখন আর নিজের দায় থাকে না...
সাকিব: না, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টসটা খুব জিততে চেয়েছি। জানতাম, রাতে শিশির পড়ে। খুব করে চাইছিলাম যেন টসটা না হারি। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মনে হচ্ছিল, টসটা না জিতলেই ভালো। কারণ আমার মনের ইচ্ছা ছিল প্রথমে ফিল্ডিং করা। কিন্তু দলের বেশির ভাগই বলল, শিশির-টিশির যেহেতু পড়ছে না, আগে ব্যাটিং করে নেওয়াই ভালো। আমিও ভাবলাম, ঠিক আছে তা-ই করি।
আমি তো ভেবেছিলাম, ৫৮-এর দুঃস্বপ্নটা এত টাটকা যে সে কারণেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমে ব্যাটিং করেননি...
সাকিব: না, সেটা কারণ নয়। আমরা জানতাম, ডিউ হবে। ৭টা থেকেই শিশির পড়তে শুরু করবে। তা-ই হয়েছে। ওদের তো মাত্র একটা স্পিনার, আমাদের চারটা। পরে বোলিং করলে আমাদের খুব সমস্যা হয়ে যেত। অনেক ডিউ ছিল। এমন একটা সুবিধা পাওয়ার পর আমাদের আরও ভালো ব্যাটিং করা উচিত ছিল। আরও ভালোভাবে জেতা উচিত ছিল।
হোটেলে ফিরতে ফিরতে তো ২টা বেজে গেছে। সেলিব্রেট করার সুযোগ তো ছিল না...
সাকিব: সেলিব্রেট আমরা সেভাবে অনেক দিনই করি না। এই দলের বেশির ভাগই নামাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। খেলার বাইরে যার যার আলাদা লাইফ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
‘আমরা করব জয়’ গাওয়া হয়নি?
সাকিব: তা তো গেয়েছিই। এ দিন একটু জোরেই গেয়েছি। ড্রেসিংরুমের আশপাশে যারা ছিল ওরা শুনেছে।
এখন বাংলাদেশ দলের লিড সিঙ্গার কে?
সাকিব: লিড সিঙ্গার নাই। যারা ক্রুশিয়াল পারফরম্যান্স করে, তাদের মাঝখানে রেখে আমরা সবাই গাই।
এ দিন মাঝখানে কে ছিলেন—শফিউল?
সাকিব: শফিউল, রিয়াদ ভাই, ইমরুল।
এই তিনজন টেবিলের ওপরে আর আপনারা সবাই চারপাশে?
সাকিব: টেবিল ছিল না, ওরা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়েছিল।
আপনি নাকি কান্নাকাটিও করেছেন?
সাকিব: (হাসি) আমি সবার শেষে মাঠে ঢুকেছি। ঢোকার পর কী যে হলো, চোখে পানি এসে গেল। এমন হবে বুঝিনি, ২-১ মিনিট পরই অবশ্য নিজেকে কন্ট্রোল করে ফেলেছি।
এর আগে কোনো জয়ে এমন হয়েছে?
সাকিব: অনেকবারই হয়েছে...(হাসি)...অনেক গুলো উইনেই হয়েছে।
এমনিতে তো আপনার আবেগ-টাবেগ একটু কম বলে জানে সবাই। সাকিব আল হাসান কি তাহলে শামুকের মতো...বাইরে শক্ত খোলস আর ভেতরটা খুব নরম?
সাকিব: (হাসি) এটা বলা মুশকিল। আমি কেমন, সেটি আমি কীভাবে বলি! আমাদের দলে অনেকেরই এমন হয়। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের পরও তো দেখি অনেকে কাঁদছে।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কী মনে হয়েছে?
সাকিব: মনে হয়েছে কোনো টেনশন নাই। আজ কোনো কাজ নাই।
এটা তো মানসিক অবস্থার কথা বললেন। নির্দিষ্ট কিছু মনে হয়নি?
সাকিব: দুটি জিনিস মনে হয়েছে। এক, এই সিচুয়েশনে এভাবে জিতে গেলাম! আর মনে হয়েছে, যদি আমি শেষ করে আসতাম, তাহলে পুরোটা সুন্দর হতো। স্টেজটাও সেট করা ছিল।
আপনি আউট হয়ে যাওয়ার পর তো ম্যাচটা ইংল্যান্ডের হাতে চলে গিয়েছিল। আউট হওয়ার পর ড্রেসিংরুমে ফেরার পথটা নিশ্চয়ই খুব দীর্ঘ মনে হয়েছে?
সাকিব: খু-উ-ব। শুধু নিজের চাওয়া নয়, ওই সব পরিস্থিতিতে টিম আমার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করে। না পারলে তাই নিজের কাছে আরও বেশি খারাপ লাগে।
ওই শটটা খেলার আগ পর্যন্ত তো আপনি তো খুব বুঝেশুনে ব্যাটিং করেছেন...
সাকিব: আমি আমার লাইফে এত কষ্ট করে ৩২ রান করিনি। ৩২ করতে এত কষ্ট করা লাগে না। আমি শুধু চিন্তা করেছি, থাকা লাগবে। আমরা ৫০ ওভার খেললে ওদের জেতার চান্স নাই। শেষ পর্যন্ত ব্যাটসম্যান থাকলেও ওরা পারবে না। ৪০ ওভার হোক, তখন যা করার করব।
জয়ের পর আপনি প্রথম কাকে ফোন করেন?
সাকিব: আমি কাউকেই ফোন করি না।
মা-বাবাকেও না?
সাকিব: না।
প্রধানমন্ত্রী তো আপনাকে ফোন করেছেন। কী বললেন উনি?
সাকিব: শুধু আমার সঙ্গে না; উনি তামিম, রিয়াদ, শফিউলের সঙ্গেও কথা বলেছেন। বলেছেন, ‘আমি পুরো খেলা দেখেছি। খুব ভালো খেলেছ। মাঝখানে কয়েকটা উইকেট পড়ে ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল। তুমি আরেকটু টেনে দিয়ে আসতে পারলে এত কষ্ট হতো না।’ তার মানে উনি আসলেই পুরো খেলা দেখেছেন (হাসি)।
এক শুক্রবারে ৫৮, আরেক শুক্রবারে এমন জয়! এই এক সপ্তাহ কি বয়স অনেকটা বাড়িয়ে দিল নাকি?
সাকিব: অনেক কিছু শিখেছি। জয়ের চেয়ে পরাজয়ে যেমন অনেক বেশি শেখা যায়, তেমনি ভালো সময়েও অনেক ভুল ধরা পড়ে না। ও সব চিন্তা করতে চাই নাই। কিন্তু রুমে যখন একা থেকেছি ঠিকই মনে হয়েছে। শিখলাম, অনেক কিছু শিখলাম।
বিশ্বকাপের এই ২২ দিনকে কীভাবে বর্ণনা করবেন?
সাকিব: এক দিন ভালো তো এক দিন খারাপ। ইন্ডিয়ার সঙ্গে হারলেও সব মোটামুটি ঠিকঠাক ছিল। আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে জেতার পর ‘ঠিক’। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারার পর ‘সব ভুল’। ইংল্যান্ডকে হারানোর পর আবার ‘সব ঠিক’। যেন সাগরের ঢেউয়ের মতো...(হাসি)।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় তো আবার কোয়ার্টার ফাইনালের আশা জাগিয়ে তুলল, কী হলে কী হবে হিসাব-নিকাশ করেছেন?
সাকিব: আপাতত হল্যান্ড ম্যাচটা নিয়েই ভাবছি। কাল (পরশু) খেলা শেষ হওয়ার পরপরই আমরা ২-৩ মিনিট বসে আলাপ করেছি। এত দিন ডে-নাইট ম্যাচ খেলেছি, পরের দুটি ম্যাচ দিনে। সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছি, রুটিন বদলাতে হবে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ এমন দুঃখ দেওয়ার পরও এখন নিশ্চয়ই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাপোর্টার! ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতলেই তো আমাদের কাজ হয়ে যায়...
সাকিব: হ্যাঁ, ইংল্যান্ড হেরে গেলে ১৪ তারিখের ম্যাচটা (হল্যান্ডের বিপক্ষে) জিতলেই আমাদের হয়ে গেল। আজকের (গতকাল) ম্যাচে যদি ইন্ডিয়া জিতে যায়, আর ইংল্যান্ড যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জেতেও, আমাদের সে ক্ষেত্রে শেষ দুটি ম্যাচ জিততে হবে। ইন্ডিয়া জিতলে আমরা যদি হল্যান্ডের সঙ্গে জিতি, তা হলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আমাদের শেষ ম্যাচটি পর্যন্ত সুযোগ থাকবে। দেখা যাক, কী হয়!
http://www.prothom-alo.com/detail/da...13/news/138115
Loved it.
__________________
~*Islam is the only way to attain peace in life, be it personal, family or political.*~
|