Not sure if we had threads on this famous topic, but thought perhaps we need to go/know bit in detail, and please provide whatever information we have around. Many people those who worked behind, made the announcement happen to the globe, put their life in risk ... all deserve our heartfelt salute, lets not be fooled by the foolish and their whatever reason.
মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই ২৬ মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার বেতার ঘোষণা প্রচারের জন্য ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এর গোড়াপত্তন হয়। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পরিচালিত সামরিক গণহত্যার খবর, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এ বেতারকেন্দ্র থেকেই প্রচারিত হয়। এ বেতারকেন্দ্র থেকে সর্বশক্তি দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। গণহত্যা শুরুর আগে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বিদেশি সাংবাদিকদের বহিষ্কার এবং সংবাদ প্রচার ও প্রকাশের ওপর সামরিক আইনের কড়াকড়ির কারণে এ সময়ের আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমকে বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়গুলোর জন্য প্রধানত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিষয়ের ওপরই নির্ভর করতে হয়। পাকিস্তান সরকারের প্রচারণার বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারযুদ্ধে নেমে মুক্তিযুদ্ধের ‘দ্বিতীয় ফ্রন্ট’ হিসেবে কাজ করে।
চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র আগ্রাবাদে অবস্থিত বেতার ভবন ও কালুরঘাট ট্রান্সমিটার—এ দুটির সমন্বয়ে গঠিত। আগ্রাবাদ বেতার ভবন থেকে অনুষ্ঠান টেলিফোন লাইন, এফএম ট্রান্সমিটার অথবা এক্সটিএলের মাধ্যমে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে পাঠানো হতো। কালুরঘাট ট্রান্সমিটার তা গ্রহণ করে ৩৪৪.৮ মিটার বা ৮৭০ কিলোহার্জে তা প্রচার করে। কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্র একটি ছোট স্বয়ংসম্পূর্ণ ইমারজেন্সি স্টুডিও ছিল। চট্টগ্রাম বেতারের প্রচারক্ষমতা ছিল ১০ কিলোওয়াট, ইমার্জেন্সি স্টুডিও ব্যবহারের সময়ও ওই ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাই ব্যবহূত হতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারক্ষমতাও ছিল ১০ কিলোওয়াট। কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্র ির অবস্থান চান্দগাঁও এলাকায়, বর্তমানে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের উত্তর পাশে অবস্থিত।
২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর, অর্থাত্ ২৬ মার্চের প্রথমার্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা পাওয়ার পর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতারা, এমনকি স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাধারণ জনগণ তা হাতে লিখে, সাইক্লোস্টাইল করে, মাইকিং করে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। ২৬ মার্চ সকালে আওয়ামী লীগ ও চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা আখতারুজ্জামান বাবুর বাসভবন ‘জুপিটার হাউস’-এ এক বৈঠকে মিলিত হন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেন। ডা. জাফর ঘোষণাটি বাংলায় মুসাবিদা করেন এবং কমিটি তা অনুমোদন করে। সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরীসহ চট্টগ্রামের এমএনএ/এমপিএদের মধ্যে যাঁরা চট্টগ্রাম শহরে আছেন, তাঁরা একত্রে বেতারকেন্দ্রে যাবেন এবং জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে প্রচার করবেন।
উল্লেখ্য, ২৬ মার্চ প্রভাতি অধিবেশনের জাতীয় অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে সামরিক আইনের ধারাসমূহ প্রচারিত হওয়া মাত্রই চট্টগ্রাম বেতারের কর্তব্যরত স্বাধিকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ কর্মীরা তাত্ক্ষণিকভাবে আগ্রাবাদ বেতার ভবন ও কালুরঘাট সম্প্রচার ভবন ত্যাগ করেন।
২৬ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মোট ১৩টি অধিবেশন সম্প্রচার করে বলে জানা যায়। এর মধ্যে ২৬ মার্চের তিনটি ও ২৭ মার্চের প্রভাতি অধিবেশনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ছিল না এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বেতারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্র র স্বয়ংসম্পূর্ণ স্টুডিও সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। এ জন্য এ পর্যায়ের উদ্যোক্তারা বেতার চালু করার জন্য প্রথমে আগ্রাবাদ বেতার ভবনে যান। আগ্রাবাদ বেতার ভবন চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি স্থানে অবস্থিত। চট্টগ্রাম বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক, সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক, আঞ্চলিক প্রকৌশলীদের পরামর্শে চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থানরত পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজের শেলিং আওতা থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত কালুরঘাটের ইমার্জেন্সি স্টুডিও থেকে বেতার চালু করা হয়। পরবর্তী অধিবেশনগুলো এখান থেকেই প্রচারিত হয়।
২৬ মার্চের প্রথম অধিবেশন: স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে প্রচারের লক্ষ্যে ১২টার পর আতাউর রহমান খান কায়সার, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, মীর্জা আবু মনসুর, ডা. এম এ মান্নান, এম এ হান্নান, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, রাখাল চন্দ্র বণিক প্রমুখ আগ্রাবাদ বেতার ভবন হয়ে কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্র যান। অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ছাত্রনেতা রাখাল চন্দ্র বণিককে। বেলা দেড়টা-দুইটার দিকে রাখাল চন্দ্র বণিক বেতারে ঘোষণা করেন, ‘চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র। একটি বিশেষ ঘোষণা। একটু পরেই জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ হান্নান। আপনারা যাঁরা রেডিও খুলে বসে আছেন, তাঁরা রেডিও বন্ধ করবেন না।’ এ ঘোষণাটি রাখাল চন্দ্র বণিকের কণ্ঠে বারবার প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাসহ ডা. জাফরের মুসাবিদাকৃত ভাষণটি এম এ হান্নান প্রচার করেন। এ ভাষণটি ডা. মান্নানসহ আরও কয়েকজনের কণ্ঠে প্রচার করা হয়েছিল বলে জানা যায়। অনুষ্ঠান ঘোষণাসহ এ অধিবেশনের স্থায়িত্বকাল ছিল প্রায় ১৫ মিনিট। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এই প্রথম এ অধিবেশনে কারিগরি সহায়তা দিয়েছিলেন আঞ্চলিক প্রকৌশলী মীর্জা নাসির উদ্দিন, বেতার প্রকৌশলী আবদুস সোবহান, বেতার প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন এবং মেকানিক আবদুস শুকুর।
লক্ষণীয় যে ২৬ মার্চ সকালে সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত ছিল: জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে প্রচার করবেন; কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে জহুর আহমদ চৌধুরীর উপস্থিতি পাওয়া যায় না। যাঁরা বেতারকেন্দ্রে যান, তাঁরা ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি। দীর্ঘদিন থেকে চট্টগ্রাম শহর ও জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল, এটা কি সেই দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ? অবশ্য বেতারকেন্দ্রে যাওয়া নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, তাঁরা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসায় গিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি অসুস্থতার অজুহাতে বেতারকেন্দ্রে যেতে রাজি হননি।
বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পর (কলামিস্ট) ইদরিস আলমের ভাষ্যমতে, জহুর আহমদ চৌধুরী একজন সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক স্বাধীনতার বেতার ঘোষণা প্রচারের ওপর জোর দেন। অতঃপর নেতারা প্রথমে ক্যাপ্টেন রফিকের (পরে মেজর ও মন্ত্রী) সঙ্গে যোগাযোগ করেন; কিন্তু তিনি রণাঙ্গন ছেড়ে শহরতলিতে অবস্থিত বেতারকেন্দ্রে যেতে রাজি হননি। এরপর মেজর জিয়ার (পরে লে. জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি) সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
দ্বিতীয় অধিবেশন: ২৬ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম বেতারের পাণ্ডুলিপিকার বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁর বন্ধু ফটিকছড়ি কলেজের উপাধ্যক্ষ আবুল কাসেম সন্দীপ, বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক আবদুল্লাহ আল ফারুক সংগ্রাম পরিষদের আনুকূল্যে বেতার চালু করার উদ্দেশ্যে স্টেশন রোডে শহর আওয়ামী লীগের অফিস ও সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ‘রেস্ট হাউসে’ যান। এখানে অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁরা বেতারের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে দেখা করেন। অতঃপর বেতার চালু করার জন্য কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্র হয়ে আগ্রাবাদ বেতার ভবন হয়ে পুনরায় কালুরঘাটে গিয়ে বেতার চালু করেন। বেতার চালু করা পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন কাজী হোসনে আরা, ডা. আনোয়ার আলী, ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার আসিকুল ইসলাম, ডা. সুলতান-উল-আলম, কবি আবদুস সালাম, ডা. আবু জাফর ও এম এ হান্নান।
২৬ মার্চ সন্ধ্যা সাতটা ৪০ মিনিটে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি’—এ বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় অধিবেশন। কবি আবদুস সালাম কর্তৃক কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় মূল অধিবেশন। এরপর ডাক্তার আনোয়ার আলীর কাছ থেকে পাওয়া বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত ‘জরুরি ঘোষণা’ শীর্ষক স্বাধীনতার ঘোষণা-সম্পর্কিত প্রচারপত্রটি বিভিন্ন কণ্ঠে বারবার প্রচারিত হয়। বহির্বিশ্বের সাহায্য কামনায় ইংরেজিতে নিউজ বুলেটিনে কণ্ঠ দেন বেতারের প্রযোজক আবদুল্লাহ্ আল ফারুক। কবি আবদুস সালাম স্বাধীনতার পক্ষে ও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলার সর্বস্তরের জনগণকে যার হাতে যা আছে তা নিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন। এ সময় এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পুনঃপ্রচার করেন। গণসংগীতের মাধ্যমে আধা ঘণ্টা স্থায়ী এ অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে। পরদিন সকাল সাতটায় আবার অনুষ্ঠান প্রচারের ঘোষণা দিয়ে অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষিত হয়। বেতারে কারিগরি সহায়তা দেন বেতার প্রকৌশলী মুসলিম খান, দেলোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ মুছা ও মেকানিক আবদুস শুকুর।
তৃতীয় অধিবেশন: বেলাল মোহাম্মদের বন্ধু মাহমুদ হোসেন, বেতারের নিজস্ব শিল্পী রঙ্গলাল দেব চৌধুরী ও ঘোষক কবির, আগ্রাবাদ হোটেলের কর্মাধ্যক্ষ ফারুক চৌধুরী প্রমুখের উদ্যোগে রাত ১০টার দিকে তৃতীয়বারের মতো বেতার চালু হয়। এ অধিবেশন সম্পর্কে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়।
২৭ মার্চের প্রথম অধিবেশন: ২৭ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ প্রতিরোধ কেন্দ্রের ছাত্রনেতারা বেতার চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। ছাত্রনেতাদের মধ্যে আলোচনাক্রমে মেডিকেল কলেজের মাহফুজুর রহমান, বেলায়েত হোসেন, আবু ইউসুফ চৌধুরী, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, পলিটেকনিক্যালের (ভিপি) আবদুল্লাহ আল হারুন, আজিজ, খুরশিদসহ অনেকে কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্র যান। এ সময় ডা. এম এ মান্নান এমপিএ ও আবুল কাসেম সন্দীপ তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। বেতারকেন্দ্র চালু করে প্রথম ভাষণ দেন ডা এম এ মান্নান। এরপর সংবাদ পাঠ করেন শাহ-ই-জাহান চৌধুরী ও মাহফুজুর রহমান, ইংরেজি সংবাদ পাঠ করেন বেলায়েত হোসেন এবং মাহফুজুর রহমান সংবাদ বুলেটিন পড়েন। আবদুল্লাহ আল হারুন একটি ভাষণ দেন। সবশেষে ইউসুফ চৌধুরী একটি প্রতিবেদন পড়েন। এ অধিবেশনে দেশাত্মবোধক গানও প্রচার করা হয়। ঘণ্টা দু-তিনেক থাকার পর উদ্যোক্তারা শহরে যুদ্ধের অন্যান্য কাজে চলে যান। এ অধিবেশনে মেকানিক আবদুস শুকুরও উপস্থিত ছিলেন।
২৭ মার্চের ২য় (সান্ধ্য) অধিবেশন: ২৭ মার্চ সকালে সংগঠকদের মধ্যে বেলাল মোহাম্মদ তাঁর বন্ধু মাহমুদ হোসেন, কাজী হাবিব উদ্দীন, এয়ার মাহমুদ, ফারুক চৌধুরী, ওসমান গণিকে নিয়ে বেতারের নিরাপত্তাব্যবস্থ নিশ্চিত করতে বোয়ালখালীর ফুলতলীতে অবস্থানরত মেজর জিয়ার কাছে যান। মেজর জিয়া বেতারের নিরাপত্তার জন্য একটি সেনাদল পাঠান। বিকেল পাঁচটার মধ্যে সেনারা বেতারকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে এলাকাটির নিরাপত্তা জোরদার করেন। সন্ধ্যার মধ্যে মেজর জিয়া বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে বেতারকেন্দ্রে উপস্থিত হন। এরপর মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর প্রথম ঘোষণাটি দেন।
মেজর জিয়ার দ্বিতীয় ঘোষণা: ২৮ মার্চ মেজর জিয়া নিজেকে ‘অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান’ দাবি করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর দ্বিতীয় ঘোষণাটি দেন।
মেজর জিয়ার তৃতীয় ঘোষণা: ২৮ মার্চের অধিবেশনে মেজর জিয়া নিজেকে ‘Provisional head of the Swadhin Bangla Liberation Government’ বলে ঘোষণা করলে রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সচেতন মহলে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে সেনা-অভ্যুত্থান হিসেবে প্রচার করার সুযোগ পেত। এ জন্য তাঁরা এটার সংশোধনী প্রচারে সক্রিয় হয়েছিলেন। পাকিস্তানের একসময়কার শিল্পমন্ত্রী ও বিশিষ্ট শিল্পপতি এ কে খান এবং চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতারা, বিশেষ করে জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, মীর্জা মনসুর, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, এম এ হান্নান প্রমুখ যৌথভাবে একটি ঘোষণা তৈরি করেন। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও মীর্জা মনসুর ২৯ মার্চ রাতে এ ঘোষণাটি নিয়ে মেজর জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। মেজর জিয়াসহ তাঁরা তিনজন বেতারকেন্দ্রে আসেন, কিন্তু তখন সেখানে বেতারের কর্মীরা ছিলেন না। মেজর জিয়া, মীর্জা মনসুর ও মোশাররফ হোসেন বেতার চালু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তখন মেজর জিয়া সেনাদের বেতারকর্মীদের ধরে আনার নির্দেশ দেন। ২৯ মার্চ রাতে সেকান্দর হায়াত খান ও তাঁর ভাই হারুন-অর-রশীদ খান তাঁদের বাড়িতে বেতারকর্মীদের থাকা ও খাওয়ার আয়োজন করেছিলেন। ২৯ মার্চ সান্ধ্য অধিবেশনের পর বেতারকর্মীরা বেতারকেন্দ্র বন্ধ করে সেকান্দর হায়াত খানদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেনারা তাঁদের গভীর রাতে সেখান থেকে ধরে বোয়ালখালীতে মেজর জিয়ার কাছে নিয়ে যান। ৩০ মার্চ প্রভাতি অধিবেশনে মেজর জিয়া ২৮ মার্চের ঘোষণা সংশোধন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সরকার গঠন এবং তাঁর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত উল্লেখযোগ্য অন্যান্য বিষয়: ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পর ২৭ মার্চ পাকিস্তান সরকার বেতারে বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তারের খবর প্রচার করে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শুনলে জনগণের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও হতাশা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা ছিল। এ জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তা অস্বীকার করে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় বিপ্লবী পরিকল্পনা কেন্দ্র থেকে মুক্তিবাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। স্পষ্টতই এ পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করেছিল। ২৮ মার্চ পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সচিত্র খবর সংবাদপত্রে প্রকাশ করে তা প্রমাণ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তা বরাবরই অস্বীকার করে, এমনকি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সরকার গঠন এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় বিপ্লবী পরিকল্পনা কেন্দ্রে অবস্থান করছেন বলে প্রচার করা হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিভিন্ন প্রোপাগান্ডার মধ্যে অন্যতম ছিল মুক্তিবাহিনী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান ও তাঁর সঙ্গীদের নিহত হওয়ার খবর। এ-সম্পর্কিত প্রথম খবরটি প্রচারিত হয় ২৭ মার্চ। এ প্রোপাগান্ডায় বিবিসিসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী গণমাধ্যম প্রভাবিত হয়েছিল।
বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ইত্যাদির বরাত দিয়েও বেশ কিছু প্রোপাগান্ডা চালানো হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে অন্তর্বিরোধের খবরও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একাধিকবার প্রচার করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলার মুখে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে বাঙালি একা নয়, বিশ্বজনমত বাঙালির পক্ষে—স্বাধীনতাক মী বাঙালি জনগণের মনোবল চাঙা রাখার জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এ ধরনের কিছু খবর প্রচার করা হয়।
২৮ মার্চের প্রভাতি অধিবেশন থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত অধিবেশন প্রচারিত হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়: প্রথম অধিবেশন সকাল নয়টার পর, দ্বিতীয় অধিবেশন বেলা একটার পর এবং সন্ধ্যা সাতটার পর তৃতীয় অধিবেশন। নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠান প্রচার সম্ভব ছিল না বলে শ্রোতাদের উদ্দেশে এভাবে আগাম ঘোষণা দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ ও চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ চালু করলেও তার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ কিংবা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। অবশ্য বেতার চালু হওয়ার শুরু থেকে এর সঙ্গে সামগ্রিকভাবে জড়িত ছিলেন কালুরঘাট সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক সেকান্দর হায়াত খান। তিনি ও তাঁর ভাই হারুন-অর-রশিদ খানের নেতৃত্বে বেতারকেন্দ্রের আশপাশের লোকজন বেতারকর্মী ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের খাবারের ব্যবস্থা করত।
প্রথম দিকে বেতারের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন ইপিআর সেনারা। ২৭ মার্চের বিকেল থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বেতারের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়। ২৭ মার্চের সান্ধ্য অধিবেশনের পূর্ব পর্যন্ত কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম কিংবা কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিল না। এর পর থেকে বেতারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়াও সামরিক কর্মকর্তারা বেতারে প্রচারিতব্য বিষয়গুলো পড়ে অনুমোদন করে দিতেন।
৩০ মার্চ প্রভাতি অধিবেশনে অনুষ্ঠানের সূচনায় ও সমাপ্তিতে ঢাকা রেকর্ডের ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটির এপিঠ-ওপিঠ বাজানো হয়। সূচকসংগীত হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শেষ দিন পর্যন্ত ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটির প্রচার চালু ছিল। নভেম্বর থেকে সমাপ্তিতে জাতীয় সংগীত প্রচার করা হয়। ৩০ মার্চ প্রভাতি অধিবেশন থেকেই সমাপ্তি ঘোষণায় ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, আমি তখনই কোনো জাতিকে সাহায্য করি, যখন সে জাতি নিজেকে সাহায্য করে’—এ বাক্যটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ দিন পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
৩০ মার্চ দুপুরে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বোমা হামলায় বেতারকেন্দ্রের বিদ্যুত্ সরবরাহ, বৈদ্যুতিক চ্যানেলগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্র ১০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার ছাড়াও এক কিলোওয়াটের একটি স্বতন্ত্র ট্রান্সমিটার ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার অব্যাহত রাখার জন্য এ ট্রান্সমিটারটি ডিসমেটাল করে প্রথমে পটিয়া, পরে পটিয়া থেকে রামগড় হয়ে ভারতের আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নামকরণ: ২৬ মার্চের প্রথম অধিবেশনে সংগঠকেরা এ বেতারকেন্দ্রকে ‘চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র’, ‘বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ ইত্যাদি বলে উল্লেখ করেন। রাখাল চন্দ্র বণিক বলেন, প্রথমে ‘চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র’ বলে ঘোষণা দিলেও পরে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ বলে তিনি ঘোষণা করেন। এ প্রসঙ্গে তত্কালীন বেতারের মেকানিক আবদুস শুকুর বলেন, তাঁরা খুব নার্ভাস ছিলেন এবং তাড়াহুড়ো করছিলেন। অন্যকিছু না বলে ‘বিপ্লবী বেতার থেকে বলছি’ বলে একজন তরুণ ঘোষণা দেয়। ২৬ মার্চের দ্বিতীয় অধিবেশনে এটাকে একটি গুপ্ত বেতারকেন্দ্র হিসেবে শুধু বেতারকেন্দ্রের নাম ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ বলে প্রচার করা হয়। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা সাতটা ৪০ মিনিটে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি’—এ বাক্যের মাধ্যমে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের’ দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়। ২৬ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ নামকরণ করা হলেও এ নামটি সব সময় হুবহু ব্যবহার করা হয়নি। যেমন, ২৮ মার্চের প্রভাতি অধিবেশনে আবুল কাসেম সন্দীপের পড়া সংবাদ বুলেটিনে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’, ‘বাংলা বেতার কেন্দ্র’, ‘বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ ইত্যাদি নাম উল্লেখ করা হয়। ২৮ মার্চের দুপুরের অধিবেশন থেকে মেজর জিয়ার নির্দেশে লে. শমশের মবিনের (পরে পররাষ্ট্রসচিব ও রাষ্ট্যদূত) প্রস্তাবক্রমে বেতারের নাম থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। বেতারের নাম হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ঘোষণা থেকেই বাংলাদেশ ও বিশ্বের জনগণ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলাদেশে পরিচালিত বর্বর গণহত্যা এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা জানতে পারে। স্বাধীনতার বেতার ঘোষণা ছাড়াও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনী’ গঠন এবং ‘বাংলাদেশ সরকার’ প্রতিষ্ঠার কথা প্রথম প্রচারিত হয়—এ দুটি সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অনেক পরে। ১০ কিলোওয়াটের ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এর প্রচারক্ষমতা ছিল মাত্র ৬০ বর্গকিলোমিটার। এ জন্য পুরো দেশের জনগণ এ কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সরাসরি শুনতে পায়নি। তবে বৈশ্বিক গণমাধ্যম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঘোষণাগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করায় দেশবাসী ও বিশ্ববাসী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনাপর্বের কথা জানতে পারে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠালগ্নে বেতার প্রকৌশলী আবদুস সোবহান ও দেলোয়ার হোসেন এবং কাস্টসম কর্মকর্তা এম এ হালিমও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বেলাল মোহাম্মদের মতে, নিম্নোক্ত দশজন বেতারকর্মী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত স্বতঃপ্রণোদিতভাব সম্পৃক্ত ছিলেন: মোহাম্মদ আমিনুর রহমান, কাজী হাবিব উদ্দীন আহমদ, আ ম শারফুজ্জামান, মোহাম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী, সৈয়দ আবদুস শাকের, মুস্তফা আনোয়ার, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, রাশেদুল হোসেন, আবদুল্লাহ আল ফারুক ও বেলাল মোহাম্মদ। তাঁরা ‘শব্দসৈনিক’ নামে পরিচিত।
ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল হক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Just wanted to share an untold story of some unsung heroes ! The writer is my friend's friend
Quote:
সেন্ট্রাল সুবেদার মেজর শহীদ শওকত আলী
আমার বড় চাচা...
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যার সময় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস সিগনাল সেন্টারে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলো পাকিস্তানীরা। অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়া মাত্র নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে পিলখানা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় তারা। সেই কালরাতে সোয়া বারোটার দিকে নাবিস্কো বিস্কিটের একটি টিন হাতে ধরা পড়েন সিগনাল কোরের সুবেদার মেজর শওকত আলী। সেই বিস্কিটের টিনটি ছিলো আসলে একটি ট্রান্সমিটার। তার কাছে আরো পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর লিখিত একটি মেসেজ : This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh where ever you might be and with what ever you have to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved. [Message embodying declaration of Independence sent by Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman to Chittagong shortly after midnight of 25th March, i.e. early hours of 26th March 1971 for transmission throughout Bangladesh over ex-EPR transmitter; বঙ্গবন্ধু স্পিকস : বাংলাদেশ সরকার পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের বহির্বিশ্ব প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, তৃতীয় খন্ড, পৃ.১] সেটি ট্রান্সমিটরত অবস্থাতেই গ্রেপ্তার হয়ে যান শওকত। রাত সাড়ে এগারোটা থেকেই মৃত্যুকে অবজ্ঞা করে কাজটা করে যাচ্ছিলেন তিনি।
উত্তাল সেই মার্চের শুরু থেকেই ইপিআর, মগবাজার ওয়ারলেসসহ বিভিন্ন জায়গায় গোপনে যোগাযোগ করেছিলেন মুজিব। একান্ত অনুগত কয়েকজনকে দিয়ে রেখেছিলেন নির্দেশনা। এর একটি ভাষ্য মিলে বুয়েটের অধ্যাপক নুরুলউল্লাহর (জগন্নাথ হলের গণহত্যার ভিডিওচিত্রটি ধারণ করেছিলেন যিনি) সাক্ষাতকারে : ...আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর একেবারে ভিতরের এক প্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি প্রথমে ব্যাপারটার গুরুত্ব অতোটা উপলব্ধি করতে পারিনি। অনেক ভিতরের একটা কক্ষে নিয়ে যাওয়ার পর আমি দেখলাম সেখানে সোফার উপর তিনজন বসে রয়েছেন। মাঝখানে বঙ্গবন্ধু। তার ডান পাশে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও বাঁপাশে তাজউদ্দিন সাহেব...তিনি সোফা থেকে উঠে এসে আমাকে ঘরের এককোণে নিয়ে গেলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে অত্যন্ত সন্তর্পনে বললেন, নুরুল উল্লাহ, আমাকে একটা ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিতে হবে। আমি যাবার বেলায় শুধু একবার আমার দেশবাসীর কাছে কিছু বলে যেতে চাই। তুমি আমাকে কথা দাও, যেভাবেই হোক একটা ট্রান্সমিটার আমার জন্য তৈরি রাখবে। আমি শেষবারের ভাষণ দিয়ে যাব।... ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা শওকত আলী নিজের কোয়ার্টারেই গোপনে কয়েকটি ট্রান্সমিটার তৈরী করেছিলেন। বিশ্বস্ত কয়েকজন সঙ্গীকে তা দিয়ে নির্দেশ দেন সঠিক সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকার। এদের মধ্যে দুয়েকজন পিলখানার বাইরে থেকে মেসেজ ট্রান্সমিট করতে সফল হন। তবে তাদের কারো নাম জানা যায়নি।
গ্রেপ্তারে পর ১১ নম্বর ব্যারাকে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করা হয় শওকতকে। জেরা করে তথ্য আদায়ের জন্য বাঁচিয়ে রাখা কয়েকজন ইপিআর সদস্যের সঙ্গে তাকে এরপর নিয়ে যাওয়া হয় মোহাম্মদপুর শরীরচর্চা কলেজের (পরে আলবদর সদরদপ্তর) টর্চার সেন্টারে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে আরো ছিলেন সুবেদার মোল্লা ও সুবেদার জহুর মুন্সি। এ দুজন সপরিবারে পিলখানার বাইরে থাকতেন। তাদেরকে সন্দেহ করা হয় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার সেই বার্তাটি গোপনে পিলখানায় আনার জন্য। এই অভিযোগে বর্বর নির্যাতনের শিকার হন তারা।
শওকতের স্ত্রী অধ্যাপিকা (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ফিরোজা বেগম তার মেয়ে সেলিনা পারভীনকে (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপিকা) নিয়ে স্বামীর খোজ করতে গিয়ে জানতে পারেন দেশদ্রোহীতার অভিযোগে প্রাণদন্ড দেওয়া হয়েছে তাকে। সিগনাল কোরের কমান্ডার কর্ণেল আওয়ান সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন : আপনার স্বামীকে কিভাবে বাচাবো বলুন? তিনি ইপিআর কোয়ার্টার থেকে মুজিবের ঘোষণা ট্রান্সমিট করা অবস্থায় ট্রান্সমিটারসহ ধরা পড়েছেন। তার কাছে মুজিবের লিখিত মেসেজ পাওয়া গেছে। ফিরোজা বেগম এরপর তার দেবর মেজর সাখাওয়াত আলীর (তখন পাকিস্তানে বন্দী) দুই অবাঙালী বন্ধু মেজর এজাজ মাসুদ ও ক্যাপ্টেন আখতারের সঙ্গে ঢাকা সেনানিবাসে গিয়ে দেখা করেন। তাদের মুখেও শোনা যায় একই কথা।
অনেক পরে রাজশাহী ইপিআর সিগনাল কোরের সুবেদার নাসিম আলীর কাছ থেকে স্বামীর মৃত্যুর ঘটনা বিস্তারিত জানতে পারেন ফিরোজা। নাসিম তা জেনেছেন অলৌকিকভাবে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া সুবেদার আইয়ুব আলীর কাছ থেকে। ২৮ এপ্রিল পাগলায় ২৫ জন ইপিআর সদস্যকে লাইন ধরে গুলি করা হয়, যার মধ্যে আইয়ুব আলীও ছিলেন। নদী থেকে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে গ্রামবাসী। পরে একই সাক্ষ্য দেন ইপিআর জিডি ব্রাঞ্চের স্টেনোগ্রাফার নুরুল ইসলাম ও ইপিআর সদস্য আবদুল মজিদ। ১৬ ডিসেম্বর মোহাম্মদপুর থেকে তাদের উদ্ধার করেছিলো মুক্তিবাহিনী।। শওকতের ছোট ভাই ক্যাপ্টেন সাখাওয়াত আলি , পরে মেজর , পাকিস্তান কোহাট মিলিটারি আকাডেমি তে বন্দি। ভাই আর জীবিত নেই শুনে পাল্টা আক্রমণ করে বসেন এবং তাকে গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন করে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আর্মি কাছে প্রেরন করা হয়।